গ্রামের গা ঘেঁষে শেষ শরতেও নদী ফুঁসছে। হু হু হাওয়ায় বাঁশের ম্যারাপের গায়ে পত পত করে উড়ছে ডেকরেটারের সদ্য লাগানো নীল-সাদা ডুরে কাপড়। বর্ষার ঘোর জলসিক্ত দিন পেরিয়ে গিয়েছে। নিত্য প্রাকৃতির লড়াইয়ে এ বারও বেঁচে রয়েছে নির্মল চর। সব ভুলে পুজোর পরে দীপাবলীতেও বুক বেঁধেছেন তাই চরের মানুষ।
ভগবানগোলা-২ ব্লকের নির্মলচরের রক্ষাকালীর বেশ নাম, এলাকায়। চর উজিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকেও বহু মানুষ ভিড় করেন, সাঁঝে, রাতেও। বর্ষার প্রায় হারানো চরের জনপদে জল-কাদা, আশশ্যাওড়ার জঙ্গল পেরিয়ে তাঁরা আসেন কালীর পায়ে মাথা ছোঁয়াতে। চরের মানুষের ফি-বছরের প্রাকৃতিক যুদ্ধকেও বোধহয়। রক্ষাকালীর পুজোর আয়োজনে কোনও খামতি থাকে না। চরের পুরনো বাসিন্দা ধনঞ্জয় মন্ডল বলেই ফেলেন, “ত্রুটি রাখলে চলে! কে জানে সামনের বার এ পুজো করতে পারব কিনা? পদ্মা যদি রাখে, পুজো হবে। না হলে ভেসে যাব!” তাই নির্মলচরের তিনটি পুজোর কোনটাতেই খামতি থাকে না আয়োজনের। রয়েছে কয়েকটি পারিবারিক পুজোও। ভাঙনগ্রস্ত চরে অন্তত গোটা বারো পুজোয় এখন ব্যস্ততা তুঙ্গে।
দুর্গাপুজোর মুখে এক টানা বৃষ্টিতে পদ্মা ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চরের বিঘার পর বিঘা পাট খেত। পেকে ওঠা আউস ধান হারিয়েছে বন্যায়। কলাই ধানও ধুয়ে গিয়েছে। চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে দুর্গাপুজো হয়েছে। রক্ষাকালীও হবে। বাসিন্দারা বলছেন, “নতুন করে ফসল বুনেছি। যে যা পেরেছি। দাঁড়াতে হবে তো। এখন আর ভেঙে পড়ি না।”
নতুনগ্রামের রক্ষাকালী পুজোর এক উদ্যোক্তা রেনুপদ মণ্ডল বলেন, “এলাকার স্থায়ী মন্দিরে গত ১০ বছর ধরে রক্ষাকালীর পুজোর আয়োজন হয়। প্রায় শতাধিক পরিবার এই পুজোয় অংশ নেন। ব্যক্তিগত চাঁদায় পুজোর আয়োজন হয়। আন্তরিকতায় কোনও ত্রুটি থাকে না।” রেণুপদবাবু বলেন, “বন্যা-ভাঙনে জেরবার নির্মলচরের মানুষ এই উৎসব-পার্বণের দিকে তাকিয়েই তো বেঁছে থাকেন। বিদ্যুৎহীন এলাকায় আমোদপ্রমোদের কোনও ব্যবস্থা নেই। তাই পুজো উপলক্ষে পাড়ার ছেলেরা প্রতি বছর যাত্রাপালা করে থাকে। এ বছর তারা সামাজিক পালার আয়োজন করেছে। এজন্য প্রতি দিন সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের আলোয় যাত্রাপালার মহড়া চলছে।”
লন্ঠনের আলোয় সেই মহড়া দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল রক্ষাকালী উপলক্ষ্য, প্রত্যন্ত এই চরে ঝড়-বন্যা, অভাব-অশান্তি, বদ্ধ-স্তব্ধ জীবনে এই পুজো-পালা-পার্বণই বাঁচিয়ে রেখেছে নির্মল চরকে। |