রাত তখন সওয়া তিনটে। বন্ধ ঘরে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করছেন দু’জন।
এক জন পাগলের মতো কোলাপসিবল গেট ঝাঁকাচ্ছেন। এক বার সামনের পেডেস্টাল ফ্যানটার সামনে দৌড়ে যাচ্ছেন। এক বার পাশের ঘরে। আবার ছুটে গিয়ে কালো কোলাপসিবল গেটটা জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছেন। এ ভাবে কয়েক মিনিট কাটার পরেই নীল হাফ শার্ট, কালো প্যান্ট পরা ওই লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।
অন্য জন জলপাই রঙের জংলা ছাপ শার্ট-প্যান্ট পরা। মরিয়া হয়ে তিনি মোবাইল ফোনে বারবার বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। মোবাইল হাতের মুঠোয় ধরেই গার্ড রুম থেকে ছুটে গেলেন জেনারেটর রুমের দিকে। কিন্তু জেনারেটরের কাছে যাওয়ার আগেই গেটের পাশে মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনিও।
এ ভাবেই ক্লোজড সার্কিট টিভির ক্যামেরায় ধরা পড়ল দুই ব্যক্তির মৃত্যুর মুহূর্ত। এক জন দেবপ্রসাদ বৈদ্য (৩৮)। অন্য জন বাসুদেব ঘোষ (৪৪)। প্রাক্তন সেনাকর্মী ওই দু’জনই বি টি রোডের উপর একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ‘কারেন্সি চেস্ট’-এর নৈশপ্রহরী।
সোমবার বেলা ১০টা নাগাদ ওই ব্যাঙ্কের ‘কারেন্সি চেস্ট’-এর একমাত্র প্রবেশপথের লোহার শাটার গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে, কাঠের দরজা ও কোলাপসিবল গেট ভেঙে উদ্ধার করা হল তাঁদের মৃতদেহ। পুলিশ জানায়, দেবপ্রসাদবাবুর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায়, বাসুদেববাবুর বাড়ি হাসনাবাদে। তাঁরা একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কর্মী।
মৃতদেহ দু’টি উদ্ধার করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ছয় পুলিশকর্মী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাশীপুর থানার ওসি এবং অতিরিক্ত ওসি, হোমিসাইড শাখার ওসি, দু’জন সাব ইনস্পেক্টর এবং এক কনস্টেবল। ওই ঘরে ঢুকে পুলিশকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অসুস্থ হয়ে পড়েন ব্যাঙ্কের দুই কর্মীও। স্থানীয় নার্সিংহোমে চিকিৎসার পরে অবশ্য এক জন বাদে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কাশীপুর থানার ঠিক উল্টো দিকে প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট জায়গায় দিন দশেক আগেই চালু হয়েছিল ওই ‘কারেন্সি চেস্ট’-টি। কিন্তু ব্যাঙ্কের গ্রাহক-সম্পর্কিত কোনও বিভাগ এখানে রাখা হয়নি। ব্যাঙ্কের টাকা রাখা হত ওই সুরক্ষিত ঘরে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টাকা আনা-নেওয়ার কাজ চলাকালীন ‘চেস্ট’-এ ঢোকার মুখের শাটারটি খোলা রাখা হত। কাঠের দরজা বা কোলাপসিবল গেট বন্ধই থাকত সব সময়। কাঠের
দরজার আইহোল দিয়ে আগন্তুককে দেখে, তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই দরজা খোলা হত বলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। দিনের বেলায় ওই ‘চেস্ট’-এ কাজ করতেন জনা ষোলো কর্মী। রাতেও ওই ঘরের মধ্যেই পাহারায় থাকতেন দু’জন নিরাপত্তা কর্মী। |
তবে রবিবার ছুটির দিনে সারা দিন বন্ধই ছিল লোহার ওই শাটার। খালি ভিতরের প্রহরীদের শিফ্ট বদলের সময় শাটার খোলা হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, দেবপ্রসাদবাবু ও বাসুদেববাবু রাতের শিফ্টের দায়িত্বে ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয়েছিল শিফ্ট। শেষ হওয়ার কথা ছিল সোমবার বেলা ১০টায়।
পুলিশ জানায়, সোমবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ ব্যাঙ্কের কারেন্সি চেস্ট ম্যানেজার কৌস্তভ সেনগুপ্ত এসে দরজা খোলার জন্য ডাকাডাকি শুরু করেন। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষণ ডেকেও ভিতর থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে তিনি কাশীপুর থানায় গিয়ে খবর দেন। পুলিশকর্মীরা এসে গ্যাস কাটার দিয়ে শাটার কাটেন, তার পর কাঠের দরজা ও কোলাপসিবল গেট ভাঙেন। কোলাপসিবল গেট ভাঙতেই তাঁরা দেখেন, ভিতরে আলো জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে। সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন নীল শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক নিরাপত্তারক্ষী। জলপাই পোশাক পরা অন্য আর এক জন মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন পাশের স্টোর রুমের মধ্যে। মুখময় বমি। তাঁর সামনেই পোর্টেবল একটি জেনারেটর চলছে। কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে ডান দিকে মেঝেয় টাঙানো হলুদ রঙের একটা মশারি। ঘরে কোনও জানলা নেই। একটা এগজস্ট ফ্যান থাকলেও তা খুবই ছোট। হাওয়া ঢোকার অন্য কোনও পথও নেই। দরজা খোলার পরে দেখা যায়, ঘরময় মারাত্মক ঝাঁঝালো পোড়া গন্ধ। মিনিট কয়েকও ওই ঘরে থাকতে পারছিলেন না তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরা। গ্যাসের গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসছিল তাঁদের।
ঘরে ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওসি হোমিসাইড অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বাইরে বার করে এনে নার্সিংহোমে পাঠানো হয়। কিছু ক্ষণ পরে ঘরে ঢুকে ক্লোজড সার্কিট টিভির ফুটেজ পরীক্ষা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন কাশীপুর থানার ওসি তপন প্রামাণিক। তাঁকেও বাইরে বার করে আনা হয়। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পরে তাঁকেও নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘরের ভিতরে তো বটেই, এমনকী মূল দরজাটি একটু খুললেই বাইরে বেরোচ্ছিল বিষাক্ত গন্ধ। বাইরে দাঁড়ানো মানুষও নাকে রুমাল চেপে বেশি ক্ষণ থাকতে পারছিলেন না। পোড়া, ঝাঁঝালো গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করছিল। জ্বালা করছিল চোখ। বিকেল পাঁচটা নাগাদও সেই গন্ধ কমেনি।
|
দশ প্রশ্ন |
• প্রায় বদ্ধ ঘরে জেনারেটর কেন
• কেন ধোঁয়া বেরোনোর যথেষ্ট পথ কেন রাখা হয়নি
• জেনারেটরে কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ ছিল কি
• বিপদঘণ্টা বাজেনি কেন
• বিপদে বেরিয়ে আসার জরুরি দরজা কেন নেই |
• কোন নিয়মে ১৫ ঘণ্টার ডিউটি করছিলেন রক্ষীরা
• ওই নিরাপত্তা কর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ ছিল কি
• কারেন্সি চেস্ট* খোলার সময় কাশীপুর থানাকে কেন জানানো হয়নি
• আগুন নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল কি
• দমকলের শংসাপত্র নেওয়া হয়েছিল কি না |
* ব্যাঙ্কের কোনও শাখায় নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা রাখা যায়। বাড়তি টাকা থাকে অন্য সুরক্ষিত জায়গায়।
সেটাই কারেন্সি চেন্ট। সব ব্যাঙ্কেরই বড় শাখাগুলির জন্য কারেন্সি চেস্ট থাকে। |
|
নিঃশব্দ মৃত্যু |
কী হয়েছিল কারেন্সি চেস্টে?
মিনি জেনারেটরের জ্বালানি পুড়ে তৈরি হয় বিষাক্ত গ্যাস।
|
জেনারেটরে কী জ্বালানি ছিল?
জেনারেটরের গায়ে লেখা ছিল পেট্রোল। ডিজেল ব্যবহারেও ফল একই হত।
|
কী কী বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হতে পারে?
কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅ ক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ও সালফার ডাইঅক্সাইড। |
|
এ সব গ্যাস শরীরে ঢুকলে কী হয়?
• কার্বন ডাইঅক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড শ্বাসের সঙ্গে গিয়ে রক্তে মেশে।তৈরি হয়
কার্বোক্সি-হিমোগ্লোবিন,
যা রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
মানুষ প্রথমে অজ্ঞান হয়ে যায়।
পরে হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে ঘটে ‘নিঃশব্দ মৃত্যু’। |
• হাইড্রোজেন সালফাইড খুবই বিষাক্ত, হাইজ্রোজেন সায়ানাইডের মতোই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন ‘আদর্শ মারণ গ্যাস’ হিসেবে ব্যবহার করত।
জাপান-আমেরিকায় আত্মহত্যার
জন্য এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে।
বেশি মাত্রায় (৩২০ পিপিএম*) শরীরে গেলে তীব্র শ্বাস কষ্ট ও পরে মৃত্যু। |
• সালফার ডাই-অক্সাইড শ্বাসের সঙ্গে শরীরে গেলে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। ঘটে মৃত্যু।
বাতাসে ৫ পিপিএম-এর* বেশি থাকলে তা বিপজ্জনক বলে ধরা হয়। |
*১ পিপিএম মানে মোট পরিমাণের
(এ ক্ষেত্রে বাতাসের) ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। |
সূত্রঃ ধূর্জটিপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অধিকর্তা, রাজ্য ফরেন্সিক বিভাগ |
|
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, ঘরের ত্রিস্তরীয় প্রবেশপথের চাবি রাখা ছিল ওই দুই প্রহরীর কাছেই। রবিবার রাত তিনটে নাগাদ লোডশেডিং হয়ে যায় বলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন। লোডশেডিংয়ের পরেই জেনারেটরটি চালানো হয় বলে পুলিশের অনুমান। তবে ওই মিনি জেনারেটরে ঘরের এসি চলেনি বলেই মনে করছেন পুলিশ কর্তারা। এক পুলিশ কর্তার কথায়, “এসি চললে হাওয়া চলাচল করতে পারত। কিন্তু সেটা না চলায় একেবারে শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল ঘরটার মধ্যে।” তবে লোডশেডিং হওয়ার পরে চার ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ব্যাটারি-চালিত ইউপিএস ব্যবস্থা রয়েছে বলে ব্যাঙ্কের তরফে দাবি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও জেনারেটর চালানোর প্রয়োজন কেন হল, তার কোনও জবাব অবশ্য দিতে পারেননি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ।
‘চেস্ট’-এর বাইরে বড় জেনারেটর রাখা থাকত। চুরি হওয়ার ভয়ে মিনি জেনারেটরটি বাইরে রাখা হত না বলে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানান। দুই নৈশ প্রহরী অত রাতে দরজা খুলে বাইরে বেরোনো বা বাইরে রাখা জেনারেটর চালানোর ঝুঁকি নেননি বলে পুলিশের অনুমান। সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখে পুলিশের অনুমান, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে তাঁরা শেষ মুহূর্তে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশের বক্তব্য, ফুটেজ বলছে, রাত ৩টে ২০ মিনিট নাগাদ প্রথম জন মুখ থুবড়ে পড়ে যান। পাঁচ মিনিট পরে দ্বিতীয় জন।
প্রশ্ন হল, বদ্ধ একটা ঘরের মধ্যে রাতে প্রায় ১২-১৪ ঘণ্টা দু’জন প্রহরীকে রাখার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ? ব্যাঙ্কের ‘ক্লাস্টার হেড’ প্রলয় মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “২৪ ঘণ্টাই দু’জন করে সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী ভিতরে থাকেন। বাইরে থাকেন এক জন নিরাপত্তারক্ষী। রাতে দু’জনকে ভিতরে রাখা হয় নিরাপত্তার কারণেই।” |