ডাবলুর পরে ‘ত্রাস’ আজাদ, কাঠগড়ায় তৃণমূল
রাজ্যে সরকার পাল্টেছে। সেই সঙ্গে ‘পরিবর্তন’ হয়েছে মঙ্গলকোটেও।
বাম জমানায় মঙ্গলকোটের প্রাক্তন সিপিএম উপপ্রধান ডাবলু আনসারির বিরুদ্ধে একের পর এক সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠত। এখন তোলাবাজি ও গুন্ডামির অভিযোগ উঠছে ডাবলুরই একদা সহচর, বর্তমানে তৃণমূলের আশ্রয়ে থাকা আজাদ মুন্সীর বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি জেলার ইটভাটা মালিকেরা বর্ধমান পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করেন, আজাদ ও তার দলবলের তোলাবাজির দৌরাত্মে মঙ্গলকোটে কাজ চালানো দায়। সেই ত্রাসে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকেরাও কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন, “মঙ্গলকোট থানাকে অবিলম্বে ওই দুষ্কৃতীকে ধরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
‘ব্রিক ম্যানুফ্র্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বর্ধমান ডিস্ট্রিক্ট’-এর তরফে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগে জানানো হয়েছে, বিশেষত লাখুরিয়া গ্রামের পাঁচটি ভাটার উপরে আজাদের নজর পড়েছে। সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা অফিসে এসে তোলা চাইছে। মজুত টাকা কেড়ে নিচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকে বন্দুক দেখিয়ে, বোমাবাজি করে ইটও লুঠ করছে। প্রতিবাদ করায় এক ইটভাটা মালিককে রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে এই শারীরিক নিগ্রহও করা হয়। তোলা দিতে না চাওয়ায় এক ভাটার অফিসে ঢুকে নথিপত্রও ছিনতাই করা হয়। পরে মালিকের লোক নথি চাইতে গেলে দুষ্কৃতীরা জানিয়ে দেয়, পাঁচ লক্ষ টাকা না দিলে সে সব দেওয়া হবে না।
ওই ইটভাটা মালিক সংগঠনের সম্পাদক দুলেন্দ্রনাথ মিত্রের অভিযোগ, “পুলিশ ওই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার না করায় ভাটা চালাতে ভয় পাচ্ছেন মালিকেরা। শ্রমিকেরাও কাজে আসতে আতঙ্কে ভুগছেন।” পুলিশ সুপার নিজেও কবুল করেন, “ডাবলু আনসারি-সহ প্রায় সমস্ত দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা গেলেও আজাদ মুন্সীকে আমরা ধরতে পারিনি। সে এখন মঙ্গলকোটের সবচেয়ে বড় দুষ্কৃতী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ওর মদতেই ইটভাটাগুলি থেকে তোলাবাজি-সহ নানা অপকর্ম চলছে।”
কে এই আজাদ মুন্সী?
মঙ্গলকোটে কুনুর নদী ঘেঁষা আড়াল গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকের বড় ছেলে আজাদ। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথম দিকে সে ছিঁচকে চুরিতে হাত পাকিয়েছিল। সেই সময়েই সে ডাবলু আনসারির নজরে পড়ে। প্রায় সাত-আট বছর তাঁর সঙ্গে ‘কাজ’ও করে সে। ২০০৬ সালে পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও কাজ করেছে সে। জেলার এক পুলিশকর্তার কথায়, “আজাদের জন্যই পুলিশ সেই সময়ে মঙ্গলকোটে অনেক বড় বড় ঘটনার কিনারা করতে পেরেছে।”
কিন্তু ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আজাদের কাকা ও বাবা বিরোধী দলের হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর জন্য মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেই হিসেব পাল্টে যায়। ডাবলুর দলবলের বিরুদ্ধে আজাদের বাড়ি পোড়ানো এবং গবাদি পশু লুঠের অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের পরে অগস্টে আজাদের কাকার ছেলে সাইফুলকে বাস থেকে নামিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। আজাদকেও খুনের চেষ্টা হয়।
এর পরেই মঙ্গলকোট ছেড়ে বীরভূমের কিছু তৃণমূল নেতার আশ্রয়ে চলে যায় আজাদ। বিধানসভা নির্বাচনে নানুর ও লাভপুরের বিভিন্ন জায়গায় আজাদ-বাহিনী তৃণমূলের হয়ে কাজও করেছে। ভোটের পরে সে দলবল নিয়ে মঙ্গলকোটে ফেরে। এখন তার বাহিনীতে একদা ডাবলুর সঙ্গে থাকা লোকজনও রয়েছে বলে পুলিশের কাছে খবর। নানুরে খুন ও একাধিক সংঘর্ষ ছাড়াও মঙ্গলকোটে পুলিশকে আক্রমণ, বাড়িতে আগুন লাগানো, বোমাবাজি-সহ বেশ কিছু ঘটনায় আজাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। কিন্তু তাকে ধরা যায়নি।
মঙ্গলকোটের ওসি দীপঙ্কর সরকারের দাবি, “আমরা এখন প্রতিটি ইটভাটায় রাতে মোবাইল ভ্যান পাঠাচ্ছি। মালিক বা ম্যানেজারদের ফোন নম্বরও সংগ্রহ করা হয়েছে। মাঝে-মধ্যে তাঁদের ফোন করে থানার তরফে জানতে চাওয়া হচ্ছে, কোনও সমস্যা আছে কি না। শ্রমিকদের বলা হয়েছে, কেউ তোলা চাইতে এলেই যেন থানায় ফোন করে জানানো হয়। পুলিশ দ্রুত সেখানে পৌঁছে যাবে।” তবে তাঁর খেদ, পুলিশ অভয় দেওয়া সত্ত্বেও দুষ্কৃতীদের ভয়ে শ্রমিক বা ম্যানেজারেরা অনেকেই এখনও তোলা দিচ্ছেন। তাই পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সিপিএমের অবশ্য অভিযোগ, নতুন শাসকদলের মদতেই আজাদ এখনও প্রকাশ্যে ‘দাদাগিরি’ করে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি তথা মঙ্গলকোটে দলীয় পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডল প্রকাশ্য সভায় আজাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অচিন্ত্য মল্লিকের অভিযোগ, “আজাদের জন্য আমাদের অনেকে ঘরছাড়া। পুলিশের নাকের ডগায় বসেই সে দুষ্কর্ম করে চলেছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে ধরছে না।” দলের জেলা কমিটির সদস্য দুর্যোধন সরের কটাক্ষ, “তৃণমূল নেতারা যখন তোলাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, ধরে নিতে হবে যে তাঁদের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে।”
অনুব্রতবাবু অবশ্য দাবি করেন, “তোলাবাজির সঙ্গে দলের কেউ যুক্ত থাকলে পার পাবে না। কিন্তু আজাদের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ মিথ্যা। বরং ডাবলু আনসারিই ওই সব ভাটা থেকে তোলা আদায় করত। ইটভাটা মালিকেরা সিপিএমের হাতে তামাক খেতেন। এখন রাজ্যে পরিবর্তনের পরে সিপিএম এবং কংগ্রেসের কথায় ওই মালিকেরাই আজাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।” কাটোয়ার বিধায়ক তথা রাজ্য কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “যাঁরা অভিযোগ করছেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার। এর মধ্যে কংগ্রেসের নাম টানা হচ্ছে কেন?”
আজাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা যে ঝুলছে তা অবশ্য অনুব্রতবাবু কবুল করেছেন। তাঁর আশ্বাস, “আমি ওকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছি।” আজাদ এখনও তা করেননি কেন, কবেই বা তিনি আত্মসমর্পণ করবেন, তা অবশ্য অনুব্রতবাবু বলতে পারেননি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.