ভূমি-সঙ্কট১
হিসেব-নিকেশের জটিল
জটেই আটকে জমি ব্যাঙ্ক

তিনি যখন বিরোধী নেত্রী, তখন তাঁর মুখে বারে বারে শোনা গিয়েছে সেই কথা।
রাজ্যে চৌত্রিশ বছরের বাম জমানাতেও পশ্চিমবঙ্গে কেন একটা ‘জমি ব্যাঙ্ক’ গড়ে উঠতে পারল না, সে প্রশ্ন তুলে বাম সরকারকে তখন কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। বিগত বিধানসভা নির্বাচনেও তাঁর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকারের প্রথম কাজ হবে একটা জমি ব্যাঙ্ক গঠন।
তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু তাঁর পাঁচ মাস বয়সী সরকার এখন জমি ব্যাঙ্ক তৈরির কাজে হাত দিয়ে পড়েছে অকুল পাথারে।
মে’র মাঝামাঝি ক্ষমতায় এসে দ্রুত জমি ব্যাঙ্ক তৈরির ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেইমতো প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য বিভিন্ন দফতরকে বার বার তাগাদা দিয়েছেন মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা ভূমিসংস্কার দফতরের কর্তারা। জমির হিসেবে পেতে মহাকরণে বৈঠক হয়েছে দফায় দফায়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিয়ম করে জমি-তথ্য জোগাতে মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং।
অথচ এখনও কিছুই স্পষ্ট নয়।
মহাকরণের খবর: জমি-তথ্য সরবরাহের সময়সীমা বার বার বাড়ানো সত্ত্বেও খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা স্বাস্থ্য-সহ কুড়িটি দফতর এখনও জমির নির্ভুল হিসেব পেশ করতে পারেনি। বিভিন্ন দফতরের বিভিন্ন আধিকারিকের আক্ষেপ, “কোথাও কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কোথাও ম্যাপ, রেকর্ড কিচ্ছু নেই, কোথাও আবার জমি চিহ্নিত করার লোক নেই। সব মিলিয়ে জটিল অবস্থা।” এক ভূমি-কর্তা তো পরিষ্কারই জানাচ্ছেন, “তথ্য হাতে না-আসায় বলা যাচ্ছে না, কাজ কবে শেষ হবে।”
কেন এই জটিলতা?
আধিকারিকদের ব্যাখ্যা: যে পদ্ধতিতে তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। কী রকম?
ভূমি দফতরের তৈরি পদ্ধতি মোতাবেক জমির হিসেব চাওয়া হয়েছে মোট ন’টি ভাগে। যেমন, জমি কার হাতে আছে, কোন ব্লকে, কোন মৌজায়, মৌজার নাম কী, প্লট নম্বর কী, ইত্যাদি ইত্যাদি। মোট কত জমি হাতে রয়েছে, তার মধ্যে ফাঁকা কতটা, কতটা বেদখল, এবং কত জমি নিয়ে আইনি জটিলতা সে সব তথ্যও তলব করা হয়েছে।
আর এই পদ্ধতি মেনে কাজ করতে নেমে হিমসিম খাচ্ছে সব দফতর। কেন?
প্রথমত, খাস করা জমির রিপোর্ট খুঁজে পাওয়াই মহা মুশকিল। দেখা যাচ্ছে, এর অনেক জমি নেওয়া হয়েছিল একশো- দেড়শো বছর আগে। দ্বিতীয় সমস্যা, প্লট নম্বর চিহ্নিত করা। এক মুখপাত্রের উদাহরণ, “রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের হাতে অধিগৃহীত জমি ৮৫০০ একর। তাতে ৭০ হাজারের বেশি প্লট। পূর্ত ও সেচের জমিতে প্লট কয়েক লক্ষ।” অন্য দিকে স্বাস্থ্য দফতরের যুক্তি, বিভিন্ন জেলায় তাদের হাতে থাকা জমির কাগজপত্রই লোপাট হয়ে গিয়েছে। যে সম্পর্কে বিভাগের ওএসডি অজয় ভট্টাচার্যের ক্ষোভমিশ্রিত প্রতিক্রিয়া, “জমির হিসেব তো ডাক্তারবাবুদের দেখার কথা নয়। সে তথ্য দেবে ব্লক ভূমিসংস্কার অফিস। তা হচ্ছে না বলেই হিসেব মিলছে না।” স্বাস্থ্য দফতর এ পর্যন্ত জমি-রিপোর্ট পেয়েছে সাকুল্যে তিনটে জেলা থেকে।
এ হেন জটিলতার আঁচ পেয়ে সম্প্রতি মহাকরণে বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মুখ্যসচিব সমর ঘোষ। আধিকারিকদের তিনি দ্রুত তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু কোথায় কী?
সরকারি সূত্রের খবর: স্বাস্থ্য, উচ্চশিক্ষা, শিল্প পুনর্গঠন, পূর্ত ও আইন দফতর এখনও জমি সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্যই (ফোর পয়েন্ট রিপোর্ট) পাঠায়নি। আবার প্রাথমিক রিপোর্ট পাঠালেও ব্লক ও প্লট-ভিত্তিক রিপোর্ট জমা দেয়নি স্বাস্থ্য, উচ্চশিক্ষা, আবাসন, সেচ ও জলপথ, পরিবহণ, মৎস্য, কৃষি বিপণনের মতো বেশ কয়েকটি। অন্য দিকে অনেক দফতরের পাঠানো রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে ভূমি-কর্তাদের মনে হয়েছে, হিসেবে বিস্তর জল!
রিপোর্ট দিতে এত দেরি কেন? মন্ত্রীরা কী বলছেন?
শিল্প পুনর্গঠনের জমি প্রসঙ্গে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “আমাদের তো নামমাত্র জমি। তার মধ্যে রুগ্ণ শিল্পও রয়েছে। সেগুলোকে নিয়ে পরবর্তী পন্থা স্থির করার আগে তাদের জমির হিসেব দেব কী করে?” শিল্পমন্ত্রীর উদাহরণ, “উত্তরবঙ্গে আমাদের ১৪-১৫ একর জমি আছে। সবই চা-বাগান। তার মধ্যে রুগ্ণ যেগুলো, সেগুলো সম্পর্কে সরকারি সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কিছু জানানো যাবে না।”
উচ্চশিক্ষা দফতরের জমি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলছেন, “লোকাভাবের জন্য ঠিক সময়ে হিসেব দেওয়া যায়নি।” পূর্তমন্ত্রী সুব্রত বক্সির ব্যাখ্যা, “আমাদের একলপ্তে বড় জমি নেই। সব টুকরো টুকরো। তাই তথ্য জোগাড় করতে অসুবিধে হচ্ছে।” পূর্তমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, খালপাড় বা বিভিন্ন জায়গায় বাংলো সংলগ্ন জমিকে কী ভাবে দেখানো হবে, তা ঠিক হয়নি। ফলে দেরি হচ্ছে। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “দফতরের হাতে ৩০৭৩ একর অব্যবহৃত জমি। তা প্লট হিসেবে চিহ্নিত করতেই সময় লাগছে।
সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছে ভূমি দফতরও। ভূমি-সচিব রামদাস মিনার মন্তব্য, “অসুবিধে হচ্ছে। আমরা বার বার চিঠি পাঠাচ্ছি, তাগাদা দিচ্ছি। কিছু হিসেব জমা পড়েছে। তবে অনেক দফতর ব্লক ও প্লট ধরে তথ্য না-পাঠানোয় জমি ব্যাঙ্কের কাজ শেষ করা যাচ্ছে না।”
কাজ শেষ হলেই কি শিল্প-জমির সঙ্কট মিটবে?

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.