আগের মতো অচল হল না জঙ্গলমহল। আবার সর্বত্র জনজীবন স্বাভাবিক রাখাও সম্ভব হল না। শনিবারের বন্ধ নিয়ে তৈরি হওয়া ‘পরীক্ষা’য় মোটের উপরে ‘মিশ্র’ ফল করল রাজ্য প্রশাসন।
তবে প্রশাসনের পক্ষে আশাব্যঞ্জক হল, মাওবাদীদের বন্ধের ডাকের মধ্যেও এ দিন ঝাড়গ্রাম থানাতেই পুলিশের কনস্টেবল হওয়ার আবেদনপত্র তুলতে লম্বা লাইন দিয়েছেন জঙ্গলমহলের যুবক-যুবতীরা। ভোর ৫টা থেকেই লাইন পড়েছে অনেক জায়গায়। পুরুলিয়ার বোরো থানায় আবেদনপত্র সংগ্রহে আসা জলধর বাগদি বলেন, “১৪ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসেছি। চাকরিটা খুব দরকার।” বাঁকুড়াতেও এ দিন দেড় হাজারের মতো আবেদনপত্র বিলি হয়েছে। বেলপাহাড়ি থানায় আবেদনপত্র নিতে এসেছিলেন ভুলাভেদার এক তরুণী। তাঁর বাবা রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জেলবন্দি। ওই তরুণীর সাফ কথা, “পেটে খিদে নিয়ে বিপ্লব করতে পারব না।”
অস্ত্র সংবরণে সাত দিনের যে চূড়ান্ত সময়সীমা মাওবাদীদের জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়শনিবারই তা শেষ হয়। এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বিবৃতির পাশাপাশি, শনিবার মাওবাদীরা বন্ধের ডাক দেওয়ায় জমছিল আশঙ্কার মেঘ। সে জন্যই ছিল যৌথ বাহিনীর কড়া নজরদারি। বন্ধের আগের রাত থেকে বিভিন্ন জঙ্গলে কোবরা বাহিনীকে দিয়েও তল্লাশি চালানো হয়েছে। |
শনিবার জঙ্গলমহলে বন্ধের ডাক দিয়েছিল মাওবাদীরা। তাকে তোয়াক্কা না করেই
পুলিশে চাকরির আবেদনপত্র নিতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেল ঝাড়গ্রাম থানায়। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি। |
শেষ পর্যন্ত অশান্তি ছাড়াই দিনটা উতরেছে। সেটা যদি বাহিনীর টানা টহল-তল্লাশির ‘সাফল্য’ হয়, তা হলে ঝাড়গ্রাম শহর-সহ লালগড়, বিনপুর, বেলপাহাড়ি, গোপীবল্লভপুরে সর্বাত্মক বন্ধ ইঙ্গিত দিচ্ছে, মাওবাদীরা এখনও ‘উপেক্ষণীয়’ নয় জঙ্গলমহলে। জামবনি, বেলিয়াবেড়া, নয়াগ্রাম, সাঁকরাইলে বন্ধের প্রভাব ছিল আংশিক। মেদিনীপুর সদর, শালবনি, গোয়ালতোড় ব্লকেও দোকানপাট অনেকাংশে খোলা ছিল। বাস-ট্রেকার চলেনি।
বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলেও বেসরকারি বাস প্রায় বন্ধ ছিল। তবে ছোট গাড়ি চলেছে। খাতড়া, রাইপুর, সিমলাপাল, রানিবাঁধ, বারিকুল, সারেঙ্গায় দোকানপাট খোলা ছিল। কালীপুজোর আগে বারিকুলের পরাডি মোড়, রানিবাঁধের ঘোড়াধরার হাট ছিল জমজমাট। আবার পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, বাঘমুণ্ডি ও ঝালদায় ভালই প্রভাব পড়েছিল বন্ধের। আংশিক প্রভাব ছিল আড়শা, কোটশিলা ও জয়পুরে। বলরামপুর, বরাবাজার, বোরোয় জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। মাওবাদী-বিরোধী ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’ এ দিন বলরামপুর বাজারে জনজীবন সচল রাখার পক্ষে প্রচারও করেছে।
কারও ‘প্রভাব’ কি না স্পষ্ট নয়, তবে অনেক জায়গাতেই খেটে খাওয়া মানুষ বোঝাতে চেয়েছেন কথায় কথায় বন্ধে সাড়া দিতে তাঁদের মন সায় দেয় না। বলরামপুর বাজারের সব্জি বিক্রেতা রামপদ দাস যেমন বললেন, “দিন আনা সংসার। সব্জি বিক্রি না করলে খাব কী?” জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে রানিবাঁধের ঘোড়াধরার হাটে বিক্রি করতে আসা মুকুল সর্দারের মন্তব্য, “বন্ধে তো পেট ভরবে না।”
সেচের জন্য কংসাবতীর জলের দাবি এবং বিক্ষোভ-অবস্থানের কারণে আইআরবি জওয়ানদের সাসপেন্ড করার প্রতিবাদেই শনিবারের বন্ধ, এমনটাই বিবৃতি-পোস্টার-ব্যানারে প্রচার করেছে মাওবাদীরা। শনিবার সকালে পুরনো ঝাড়গ্রাম শহরে তেমনই একটি ব্যানার চোখে পড়েছে। শহরের পেপার মিল মোড়ে রাস্তার পাশে একটি কৌটোও কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেই কৌটো থেকে পরে পটকা মিলেছে। পুলিশও নিশ্চিত নয়, ওই কৌটো মাওবাদীরাই রাস্তায় রেখেছিল, না অন্য কেউ।
মাওবাদীদের তরফ থেকে এ দিন সে অর্থে ‘আতঙ্কের উপাদান’ না থাকলেও, আমজনতার মনে শান্তি নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে তথাকথিত ‘মাওবাদী-বিরোধী’ কিছু সংগঠনের ‘অতি-সক্রিয়তা’। এ দিনই বন্ধ-বিরোধিতায় ঝাড়গ্রাম শহরে তিন-ধনুক, টাঙি-তলোয়ার নিয়ে মোটরবাইক মিছিল করেছেন ‘জনজাগরণ মঞ্চ’-এর সদস্যেরা। ওই মিছিল দেখে অনেকেই বলেছেন, “এক সময়ে মাওবাদীরাও এ ভাবেই মিছিল করিয়েছে মানুষজনকে। এখন যদি ফের অন্য পক্ষের দাপট সইতে হয় তা হলে পরিবর্তন আর কোথায়?” |