মাওবাদীদের হিংসা বন্ধে সাত দিনের সময়সীমা শেষ হল আজই। এ বার মাওবাদীদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধে যৌথ ভাবে বড় ধরনের অভিযান শুরু করতে চলেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য।
হিংসা বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে আসার জন্য মাওবাদীদের সাত দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সাড়া না মেলায় এ বারে কড়া পদক্ষেপই করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মাওবাদী দমন অভিযানের বিষয়টি নিয়ে গত কাল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘ কথাবার্তা হয়। আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গেও এ নিয়ে তাঁর আলোচনা হয়।
তবে একই সঙ্গে জঙ্গলমহলে উন্নয়নের কাজও চালিয়ে যেতে চান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আজ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আলোচনার মাধ্যমে, উন্নয়নের মাধ্যমে সমাধান চাই। গণতন্ত্রের পদ্ধতিতেই বিচ্ছিন্নতার সমাধান হবে। কিন্তু হিংসাকে কোনও মতেই আমি সমর্থন করতে পারি না। মাওবাদীদের কাছেও আমি আহ্বান জানাই, যাতে তারা মূল স্রোতে ফিরে আসে। যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে নতুন জীবনে ফিরে আসতে পারে। সেটাই গণতন্ত্রের পথ।”
তবে মাওবাদীদের নিয়ে কেন্দ্রের উদ্বেগও রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে সম্প্রতি খবর এসেছে, ‘কোবরা’ নামে একটি আদিবাসী সংগঠনের কিছু কর্মী জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড় ধরনের নাশকতামূলক কাজ করার পরিকল্পনা করছে। সংগঠনটির পুরো নাম ‘আদিবাসী কোবরা মিলিট্যান্ট ফোর্স’। নমনি অসমে ১৯৯০ সালের শেষে এই সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনটির উৎপত্তি। সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল বড়ো এবং অন্যান্য উপজাতি গোষ্ঠীর সংঘাতের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় এদের বিস্তার হয়েছে। কিছু দিন আগে এই সংগঠনের দু’জনকে রাজ্য পুলিশ উত্তরবঙ্গ থেকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই কোবরা জঙ্গিরা স্বীকার করেছে যে, তারা মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন জঙ্গলমহলে নাশকতার পরিকল্পনা করছে।
তা ছাড়া, জঙ্গলমহলে এখন ঝাড়খণ্ড থেকে তাড়া খেয়েও বহু মাওবাদী ঢুকছে। এখানেই শেষ নয়। মমতা জানতে পেরেছেন, বিহারের মুঙ্গেরে গঙ্গার ধারে অস্ত্র তৈরির বহু কারখানা রয়েছে। বহু বছর ধরেই এরা অবাধে বৈআইনি অস্ত্র তৈরি করে। এখানে দেশি গাদা বন্দুক, বোমা-সহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরি হয়। লালুপ্রসাদের জমানায় এই বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসা বেড়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি ধৃত কোবরা জঙ্গিদের এক জন মুঙ্গের থেকে এই অস্ত্র নিয়ে পৌঁছয় কোচবিহারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে, ওই বন্দুক, গুলি দেখলে বোঝার উপায় নেই, সেগুলি হাতে তৈরি। নীতীশ কুমারের জমানাতেও এই অস্ত্রের বাজার কেন ও কী ভাবে টিকে আছে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
মমতা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে আরও জানতে পেরেছেন যে, অন্ধ্রপ্রদেশে যারা তেলেঙ্গানা আন্দোলনে সক্রিয়, তাদেরও একাংশ মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। মাওবাদীদের কৌশলই হল, দেশের যে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে মদত দেওয়া। এই কারণে তারা পৃথক বিদর্ভ রাজ্যকেও সমর্থন করেছে।
অভিযান নিয়ে পরিকল্পনা করার পাশাপাশি মমতা মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করিয়ে মূল স্রোতে ফেরানোর চেষ্টাও চালাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা যাচ্ছে, মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় নীতিরও পর্যালোচনা চাইছেন তিনি। এখন মাওবাদীরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাজতে ঢোকানো হয়। মমতার বক্তব্য, যদি আত্মসমর্পণ করে কেউ মূলস্রোতে ফিরতে চায়, তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাজতে ঢোকানো হলে, সে আত্মসমর্পণ করবে কেন? দরকার, তাকে আত্মসমর্পণ করিয়ে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা, যাকে ‘কাউন্সেলিং’ বলে। তার পরে তাকে দিতে হবে জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা। মমতার এই প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।
মমতা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, উন্নয়নের মাধ্যমেই তিনি জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের হিংসার মোকাবিলা করতে চান এবং তা সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই। তবে উন্নয়ন যাতে কেবল স্লোগান না হয়ে থাকে, তার জন্য কেন্দ্র-মমতার যৌথ সিদ্ধান্ত হল:
১) উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়ণে ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার ও স্থানীয় পুলিশকে নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠন। যারা মাওবাদীদের হুমকি অগ্রাহ্য করে নলকূপ বসাবে বা অন্যান্য কাজ করবে।
২) মাওবাদী ‘কোর’ এলাকায় এখনই সম্ভব না হলে প্রথমে ‘ফ্রিঞ্জ’ এলাকায় উন্নয়নের কাজ শুরু হোক। এই কাজের সুফল দেখলে ‘কোর’ এলাকার মানুষ মাওবাদী হুমকি অগ্রাহ্য করে এই উন্নয়নের কাজে সামিল হবে।
৩) এই উন্নয়নে কোনও দলীয় রাজনীতি থাকবে না। সব দলের মানুষই এর ফায়দা পাবে। কেন্দ্র মনে করছে, তাতে মমতার সরকার আরও বেশি করে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাবে।
৪) শুধু রাস্তাঘাট বা বিদ্যুৎ নয়, মমতা এই সব এলাকায় স্কুল তৈরির কাজে বেশি জোর দিচ্ছেন।
|
কী চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী |
শিক্ষা
কোচবিহার, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর-সহ অন্তত ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আইটিআই। দু’টি আঞ্চলিক
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। গোয়ালতোড়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। |
বিদ্যুৎ
বক্রেশ্বরে ৫০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিদ্যুতের দাম বেঁধে রাখতে সরকার কয়লার দাম নিয়ন্ত্রণ করুক। |
বিমানবন্দর
শান্তিনিকেতন, দিঘা, সাগর ও সুন্দরবনে। |
খাদ্য নিরাপত্তা
কম্পিউটারিইজড রেশন কার্ডের জন্য সাহায্য। |
জলসেচ
তিস্তা ব্যারেজ, সুবর্ণরেখা প্রকল্পের জন্য সাহায্য। ডিভিসি-র ব্যারেজ, কংসাবতী,
ময়ূরাক্ষী নদীতে পলি তুলতে ৯০ শতাংশ সাহায্য। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ফারাক্কা ব্যারেজকে ৯০ শতাংশ কেন্দ্রীয় অর্থ। |
জেএনএনইউআরএম
এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সাহায্যের পরিমাণ ৩৫% থেকে বাড়িয়ে ৯০% করা। |
বিশেষ শহর
কল্যাণীকে ‘নলেজ সিটি’, বর্ধমানকে স্বাস্থ্য শহর,
দার্জিলিং-দিঘাকে পর্যটন শহর,
শান্তিনিকেতনকে ঐতিহ্য শহর করা।
(সব দাবিই দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনায়) |
কী পেলেন
পাট চাষিদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের উপর ৪০০ টাকা বোনাস দিতে রাজি কেন্দ্র।
মিলল রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলির হাল ফেরানোর আশ্বাসও |
|