পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সঙ্কট অন্য সব রাজ্যের থেকে আলাদা এই যুক্তিতে আজ জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে বিশেষ প্যাকেজ চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে ঘোর আপত্তি ইউপিএ-র শরিক নয় এমন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিলেন, শরিক বলেই মমতাকে বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া হবে, কেন্দ্রের এই ‘একচোখোমি’ তাঁরা মানবেন না। এই পরিস্থিতিতে ফাঁপরে মনমোহন সরকার। খানিকটা অসহায়ও।
মহাকরণ জয়ের পর এই প্রথম জাতীয় কোনও সম্মেলনে যোগ দিলেন মমতা। আজ ৫৬তম জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে রাজ্যের শোচনীয় আর্থিক পরিস্থিতির কথা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন তিনি। বলেন, বেহাল অর্থনীতি, ভেঙে পড়া শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সড়ক, এগুলির সবই ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ পাওয়া। ফলে রাজ্যকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রয়োজন বিশেষ আর্থিক সাহায্য।
কী ভাবে এই বিশেষ সাহায্য চাইছেন মমতা?
মমতার যুক্তি, রাজ্যের আর্থিক সঙ্কটের একমাত্র দাওয়াই হল নগদ টাকার জোগান এবং অনুদানের সমন্বয়ে তৈরি একটি বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ। রাজ্যের যোজনা বর্হিভূত খাতে ব্যয় মেটাতে মোটা নগদ অর্থ চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের বিষয়টি আলাদা ভাবে দেখে কেন্দ্রের কেন এই অর্থ দেওয়া উচিত, তার সাতটি কারণ আজ তুলে ধরেন মমতা। ঋণের বোঝা ছাড়াও বাকি কারণগুলি হল, রাজ্যের ১৯টির মধ্যে ১১টি জেলাই অনগ্রসর, বিরাট সংখ্যায় দরিদ্র সংখ্যালঘু মানুষের উপস্থিতি ও মাওবাদী সমস্যা। এ ছাড়া, পাহাড়ে পরিকাঠামোর অভাব, তিনটি দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা এবং বাম জমানায় ‘শিল্প-কৃষি-শিক্ষায় দীর্ঘ দিনের অবহেলার’ কথাও উল্লেখ করেন মমতা।
মমতার এই যুক্তি কিন্তু মানতে চাননি জয়ললিতা। বৈঠকে তিনি সাফ বলেন, “ইউপিএ-এর বড় শরিক এখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে। তাই কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে সাহায্য করছে।’’ জয়ললিতা এই দাবি করলেও পরে মমতা অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “যে যা-ই বলুক, পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু কেন্দ্রের কাছে কোনও আর্থিক প্যাকেজ পায়নি।” তিনি বলেন, “তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে আমি শুধু বলতে চাই ভনক্কম (নমস্কার)!”
পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দিলে অন্য রাজ্যও যে একই দাবি জানাতে পারে সেই আশঙ্কা কেন্দ্রের আগে থেকেই ছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের সীমাবদ্ধতার কথা বারবার উল্লেখ করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেই আশঙ্কাই আজ সত্যি হল। শুধু জয়ললিতার আপত্তি নয়। কেন্দ্রের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়ে আজ ফের সরব হয়েছে কেরল, পঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলিও। কারণ এই দুই রাজ্যের ঋ
ণের পরিমাণ যথাক্রমে ৭০ ও ৯০ হাজার কোটি টাকা। নব্বইয়ের দশকে ইন্দ্রকুমার গুজরাল যখন প্রধানমন্ত্রী, সে সময়ে তিনি পঞ্জাবকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সে প্যাকেজ আজও হাতে পায়নি পঞ্জাব। এ দিকে পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ নিজেও ওই রাজ্যের সংখ্যাগুরু শিখ সমাজের প্রতিনিধি।
এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গে বাড়তি ঋণ নেওয়ার অনুমতি এবং প্রকল্পভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দিলেও বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া যে বেশ কঠিন, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন মনমোহন। সমস্যাটি বোঝাতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা, “ধরে নিন কেন্দ্রের কাছে রাজ্যগুলিকে সাহায্যের জন্য ১০ টাকা রয়েছে। দাবিদার ১০ জন। সে ক্ষেত্রে তো এক জনকেই পাঁচ টাকা দিয়ে দেওয়া যায় না। যা রয়েছে তাই একটু কম-বেশি করে ভাগ করে দিতে হবে। অথবা সমান ভাবে।” আর সেই কাজটি যে কতটা কঠিন, তা খুব ভাল করেই জানেন মনমোহন-প্রণব। এক দিকে জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থ কাঠামো মেনে চলার দায়িত্ব। এই দুয়ের টানাপোড়েনে যথেষ্ট অসহায় অবস্থা তাঁদের।
আজ জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠককে আসলে পারস্পরিক দোষারোপের মঞ্চ হিসাবেই বেছে নিয়েছিলেন প্রায় সব মুখ্যমন্ত্রী। তবে মমতা কৌশলে নিজের দাবি-দাওয়া জানিয়ে দিয়েছেন। অন্য রাজ্যের অভিযোগের জবাবে তাঁর প্রধান যুক্তি ছিল, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ৩৪ বছরের ঋণের বোঝা রয়েছে তাঁর মাথায়। যা অন্য কোনও রাজ্যের নেই। রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক কতটা খারাপ, তা বোঝাতে গিয়ে মমতা বলেন, “ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে রাজ্যের ঋণের বোঝা ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি নবজাতকের মাথায় ২১ হাজার টাকার দেনা।” অবিলম্বে মহার্ঘ ভাতা, সুদ ও ঋণ মেটাতে রাজ্য সরকারের ২৭,৯০০ কোটি প্রয়োজন। এই যোজনা বর্হিভূত খাতেই কেন্দ্রের থেকে নগদ জোগানের জন্য দরবার করেছেন মমতা। কারণ-এই টাকা না পেলে রাজ্য ক্রমশ ঋণের দুষ্ট চক্রে আরও জড়িয়ে পড়ছে।
কী ভাবে আগের সরকারের দেনার উত্তরাধিকার তাঁর সরকারের ঘাড়ে চেপেছে, তা বোঝাতে গিয়ে মমতা বলেন, “কয়েক দশক ধরে আগের সরকার দলের স্বার্থে ব্যয় করে গিয়েছে। তার ফলে এই ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ৪৫৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০০০ সালে যে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১,৮৯৪ কোটি টাকা, ২০১১ সালে সেটাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৯২ হাজারে। মমতা বলেন, “এর একটাই কারণ, আগের বাম সরকার ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) আইন চালু করতে রাজি হয়নি। যেখানে সিকিম বাদে সব রাজ্যই ওই আইন চালু করেছে। যত ইচ্ছে ধার করে যাওয়াটাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল।”
এ তো গেল ঋণের হিসেব। মমতার বক্তব্য, রাজ্যের ১১টি অনগ্রসর জেলায় রাজ্যের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষের বাস। অনগ্রসর ঘোষিত না হলেও কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, মালদহ যথেষ্ট পিছিয়ে পড়া জেলা। পশ্চিমবঙ্গে জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই সংখ্যালঘু। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এত সংখ্যালঘু থাকলে সেখানে দারিদ্রের পরিমাণও বেশি। এ দিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গ অন্যদের থেকে আলাদা। মাওবাদী সমস্যা ঠেকাতে জঙ্গলমহলে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। এর সঙ্গে পাহাড়ের পরিকাঠামো গড়তে কেন্দ্রের সাহায্য প্রয়োজন। রাজ্যের সাতটি জেলা বাংলাদেশ, ভুটান বা নেপালের সীমান্তবর্তী। সেখানে নিরাপত্তার প্রশ্নও রয়েছে। মমতা বলেন, ১৯৭৭ সালে বামেরা ক্ষমতায় আসার সময়ে দেশের মোট কারখানার ৭.৬ শতাংশ ছিল রাজ্যে। ২০০৮-০৯ সালে তা নেমে আসে ৪ শতাংশে। কৃষি ক্ষেত্রে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১৭.৩ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭.৮ শতাংশে।
এই সব সমস্যা মেটাতে কেন্দ্রের কাছ থেকে নগদ টাকা আর অনুদান চাই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যা আদায়ে বড় বাধা। |