দশ বছর আগের প্রজাতন্ত্র দিবসের সকাল। গুজরাতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের সেই ট্র্যাজেডি যে দিন ঘটেছিল। বরাত জোরে যারা রক্ষা পেয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল বছর বারোর এক কিশোর ক্রিকেটার। মুম্বইয়ের হয়ে অনূর্ধ্ব চোদ্দো ম্যাচ খেলার জন্য তখন সে সৌরাষ্ট্রে। পরের দিন সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ম্যাচ আর তাতেই তার অভিষেক ঘটার কথা।
প্রচণ্ড ভূমিকম্পে তারাও কেঁপে উঠল। হোটেলের ঘরে ফাটল ধরে গিয়েছে। ভীত, সন্ত্রস্ত কিশোর ক্রিকেটারদের দল। দ্রুত সবাইকে বার করে এনে ফাঁকা মাঠে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে যাওয়া হল সেই মাঠে যেখানে আর কয়েক ঘণ্টা বাদে ম্যাচ খেলতে নামার কথা। শেষ পর্যন্ত কিশোর ক্রিকেটারদের দল রক্ষা পেল। বছর বারোর সেই কিশোরও বাঁচল এবং পরের দিন অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমে ৭৪ রান করে মুম্বইকে নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাল।
দশ বছর পর ইংল্যান্ডে মহাতারকা ব্যাটিং লাইন আপ বিধ্বস্ত হওয়ার মধ্যে যে তরুণ দাগ কাটলেন, তিনি আর সে দিনের রক্ষা পাওয়া কিশোর ক্রিকেটার একই ব্যক্তি। নাম অজিঙ্ক রাহানে। তাঁর বাবা মধুকর বাবুরাও রাহানে এ দিন আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “তখন আমাদের মোবাইল ছিল না। খবরও নিতে পারছি না। শুধু টিভি-তে দেখছি মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছে। অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। অজিঙ্কের কোনও খবর পাচ্ছি না। বুঝতেই পারছেন কী রকম টেনশন সকলের। শেষ পর্যন্ত রত্নাকর শেঠি রাতের দিকে সকলের বাড়িতে বার্তা পাঠালেন যে, সবাই ঠিক আছে। ম্যাচটাও তার পরের দিন হচ্ছে।” বলে সিনিয়র রাহানে যোগ করলেন, “পরের দিন যখন শুনলাম এ রমক মানসিক চাপের সঙ্গে লড়াই করেও ও ৭৪ করেছে, সে দিনই বুঝেছিলাম আমার ছেলে আর যাই হোক বিনা যুদ্ধে লড়াই ছেড়ে দিয়ে আসবে না।”
|
অনুশীলন সেরে ফিরছেন রাহানে। শনিবার। ছবি: এএফপি
|
অজিঙ্ক তাঁর বাবাকে নিরাশ করেননি। ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার প্রথম সুযোগ পেয়েই তিনি এমন একটা আবহ তৈরি করতে পেরেছেন যে, বলাবলি হচ্ছে, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। মোহালিতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়া সেই আশার আলোকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। “প্রথম দু’টো ম্যাচে তেমন রান পাইনি। তার পর ধোনি এসে বলেছিল, তোমার এত প্রতিভা। রান না পাওয়া নিয়ে একদম ভেবো না। নিজের খেলা চালিয়ে যাও। দেখবে রান ঠিকই আসবে,” এ দিন বলছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন আবিষ্কার। সঙ্গে যোগ করতে চান, “সিনিয়র ক্রিকেটাররা খুব সাহায্য করছে। নির্ভরতা দিচ্ছে। তাতে আমার কাজটা সহজ হয়ে যাচ্ছে।” বিশ্বকাপ জয়ের মাঠে তিনি প্রথম বার দেশের জার্সি গায়ে নামছেন। যা কি না আবার নিজের শহরও। রাহানে যা নিয়ে উত্তেজিত। “২ এপ্রিলের রাতটা আমরা কেউ ভুলতে পারব না। সেই ড্রেসিংরুমে আমি ঢুকছি এটা ভেবেই গর্ববোধ হচ্ছে।”
মুম্বইয়ের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তাঁর উঠে আসা। রোজ অফিস টাইমের ভিড় ট্রেনে কিটব্যাগ নিয়ে প্র্যাক্টিসে আসতেন। আবার অফিস টাইমের ভিড় ঠেলতে ঠেলতে ফিরতেন। মধুকর রাহানে বলছিলেন, “যখন বুঝলাম আমার ছেলের মধ্যে ক্রিকেট প্রতিভা রয়েছে সে দিনই ঠিক করি আমাকেও আত্মত্যাগ করতে হবে। লড়াই করতে হবে। তেমন সচ্ছল অবস্থা কোনও দিন ছিল না। তবু যা ছিল, তাই একজোট করে মুম্বইতে ফ্ল্যাট কিনি। যাতে ছেলেটাকে অন্তত কিছুটা শান্তিতে ক্রিকেটটা খেলতে দিতে পারি।” সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তিনি। স্ত্রী এবং তিন সন্তানের পরিবার। অজিঙ্ক-ই সবথেকে বড়। বংশে ক্রিকেট খেলার কোনও ইতিহাস নেই। সবচেয়ে বড় কথা, মোহালির ম্যান অব দ্য ম্যাচের সে ভাবে কোনও কোচ-ই নেই।
মধুকর রাহানে এক বার বললেন, “ছেলে মোহালিতে সেঞ্চুরি পায়নি বলে এতটুকু আক্ষেপ নেই আমার। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের জয়। সেটাতে যে ও অবদান রাখতে পেরেছে তাতেই আমি খুশি।” রবিবার ওয়াংখেড়েতে তা হলে সপরিবারে যাচ্ছেন ছেলের খেলা দেখতে? মধুকর রাহানে অবাক করলেন, “না, যাচ্ছি না। আমরা মাঠে খেলা দেখতে যাই না।” ছেলে নিশ্চয়ই আজ এসেছিল বাড়িতে? এ বার তিনি আরও অবাক করলেন। “না, না আসেনি। ও হোটেলেই আছে। ফোনে কথা হয়েছে।” শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, অজিঙ্ক রাহানের হয়তো কোনও রমাকান্ত আচরেকর নেই। কিন্তু কোনও এক রমেশ তেন্ডুলকরের তৈরি করা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, শিষ্টাচার এবং শৃঙ্খলার বেষ্টনী তাঁকে ঘিরেও রয়েছে! |