সেই ঐতিহাসিক ড্রেসিংরুম! ২ এপ্রিল রাতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি জয়ের স্ট্রোকটা নেওয়ার পর যেখান থেকে শিশুর মতো ছুটে বেরিয়ে এসেছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দল।
শনিবাসরীয় সকালে ধোনিকে সেখান থেকে বেরিয়ে ওয়াংখেড়ের নেট প্র্যাক্টিসের দিকে হেঁটে যেতে দেখে মায়াবী রাতের স্মৃতি ফিরে আসতে বাধ্য। কাপ-জয়ের স্বপ্নপূরণে ভেসে যাওয়া ওয়াংখেড়ে। গোটা মাঠ আনন্দে আত্মহারা। সচিন তেন্ডুলকর কাঁদছেন। ওই তো ওয়াংখেড়ের বাইশ গজের একটু বাঁ-দিক ঘেঁষে ড্রেসিংরুমের ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা নর্থ স্ট্যান্ড। যেখানে বল-বয় হিসেবে ক্রিকেটজীবন শুরু সচিনের। সেখানেই ২ এপ্রিল রাতে তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সতীর্থরা। সহবাগ। গৌতম গম্ভীর। হরভজন সিংহ। ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট যুবরাজ সিংহ। একে একে ক্যামেরার সামনে এসে বলে যাচ্ছেন, “কাপ উৎসর্গ করছি সচিন তেন্ডুলকরকে।”
আর ওয়াংখেড়েতে দাঁড়িয়ে কাপের স্মৃতির সাগরে এ ভাবে ডুবে যেতে যেতেই আচমকা আবিষ্কার করতে হবে যে, আরে! সচিন আশেপাশে নেই। ড্রেসিংরুম থেকে ধোনি বেরোলেন। কই সচিন তো আর বেরোচ্ছেন না! যুবরাজ কোথায়? তাঁকে তো দেখতে পেলাম না! সহবাগই বা কোথায় গেলেন? হরভজন?
তাঁদের বদলে এঁরা কারা? ওই ছেলেটাকে না হয় চেনা যাচ্ছে। মোহালিতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে এলেন। মুম্বইয়ের স্থানীয় তরুণ বলে ইতিউতি তাঁকে নিয়ে সামান্য আলোচনাও শোনা যাচ্ছে। সেই ভিড় থেকে অন্তত নামটা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। অজিঙ্ক রাহানে। বিরাট কোহলি ২ এপ্রিলের রাতেও ছিলেন। তাঁকে চেনা যাচ্ছে। সুরেশ রায়না ছিলেন। বাকিদের চেনার জন্য তো রীতিমতো পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে হবে। ধরা যাক ভারতীয় ক্রিকেটের সেই ভক্তের কথা। এমন কেউ যিনি কিনা ২ এপ্রিল কাপ-জয়ের বিজয়োৎসব সেরে-টেরে বাড়ি চলে গিয়েছেন আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ক্রিকেট পৃথিবী থেকে। মাঝের এই সাড়ে ছ’মাস কী হয়েছে কোনও খবর রাখেননি। সেই ব্যক্তি যদি ঠিক করে থাকেন আজ, ২৩ অক্টোবরের ওয়াংখেড়েতে বিশ্বজয়ী টিমের প্রত্যাবর্তন দেখতে আসবেন, কী দেখবেন তিনি?
দেখবেন, কাপ-জয়ের ঐতিহাসিক মঞ্চে ভারতীয় ক্রিকেটের নবীন বরণ অনুষ্ঠান চলছে। এক দিকে, ২ এপ্রিলের বিজয় সঙ্গীত বাজছে। অন্য দিকে, আগামী প্রজন্মকে আবাহনের গান। সচিনকে আজ আর ব্যাট হাতে বাইশ গজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যেতে পারে ভিআইপি বক্সে। নিজের শহরে ম্যাচ। মোটামুটি নিশ্চিত খবর, তরুণ ব্রিগেডের কুচকাওয়াজ দেখতে রবিবারের ওয়াংখেড়েতে আসছেন সচিন। |
বদলার সিরিজ পকেটে। এ বার লক্ষ্য পাঁচে পাঁচ।
ওয়াংখেড়ের প্র্যাক্টিসে ধোনি। শনিবার। ছবি: পিটিআই
|
মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার এক প্রভাবশালী কর্তা আবার জানালেন, বিশ্বকাপ জেতার ইতিহাসকে সাজানোর নকশা তাঁরা করে ফেলেছেন। প্যাভিলিয়নের বেসমেন্টে বিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি হচ্ছে ক্রিকেট জাদুঘর। লর্ডসের আদলে। বিশ্বকাপ জয়ের নানা মুহূর্তের ছবি সংগ্রহের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। বেসমেন্টে প্রায় দশ হাজার স্কোয়ার ফুট জায়গা। এর মধ্যে কিছুটা জায়গা ছেড়ে রাখা হচ্ছে জিমন্যাসিয়ামের জন্য। বাকিটায় শুধু মিউজিয়াম। আগামী বছরের মধ্যে যা শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ধোনির কাপজয়ী ক্রিকেটারদের থেকে নানা স্মারকও চাওয়া হবে। পাশাপাশি ফ্রেমবন্দি করে রাখা হবে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল দুই মুহূর্তকে। ২৫ জুন, ১৯৮৩-র লর্ডস আর ২ এপ্রিল, ২০১১-র ওয়াংখেড়ে। আঠাশ বছরের ব্যবধানে দুই প্রজন্মের ক্রিকেট-কোহিনুর জয়ের ছবি।
রাহানেদের তরুণ প্রজন্মের কাজটা এই আবহের মধ্যে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একে তো বিশ্বকাপ বেদীর পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের উপর বর্তাচ্ছে। কোনও ভাবে যাতে ৩-০ জিতে নেওয়া সিরিজ ১-৩ হয়ে বদলার সুর কেটে না যায়। তার উপর প্রবাসে ০-৮ বিধ্বস্ত হয়ে ফেরায় ঐতিহাসিক ফটোফ্রেমের উপর যে ঝুল-কালি পড়েছে সেটাও পরিষ্কার করে, পরম যত্নে জাদুঘরে লাগিয়ে দিতে হবে। তাঁদের সুবিধে, নবীন বরণের মঞ্চেও পাশে পেয়ে যাচ্ছেন কাপজয়ী অধিনায়ককে। আর তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, ইংল্যান্ড সফরের ক্ষত এখনও এমন দগদগে যে, একমাত্র ৫-০ করতে পারলে তবেই সাময়িক এর থেকে বেরোতে পারবেন। ধোনির আক্ষেপ যাচ্ছে না ইংল্যান্ডে এক দিনের সিরিজ নিয়ে। টেস্ট সিরিজের ফলাফল মনে হচ্ছে তিনি মেনেই নিচ্ছেন। কিন্তু ওয়ান ডে-তে একটা ম্যাচও জিততে না পারার ব্যাখ্যা এখনও খুঁজে পাচ্ছেন না।
“একটা টস জিততে পারলাম না। তার উপর এমন এমন সব সময় বৃষ্টি এসে ম্যাচ থামিয়ে দিচ্ছিল, যখন আমরা ভাল অবস্থায়। ভাগ্যটাও যে আমার সঙ্গে ছিল না সে সব বলতে গেলে কে আর শুনছে?” কিছুটা অভিমানী হয়েই বলে ফেলছেন তিনি। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের আচরণের কথা তুললে অবশ্য ‘ক্যাপ্টেন কুল’-ও ফুঁসে উঠছেন। “ওরা যা খুশি তাই বলছে মাঠের মধ্যে। সেটা কী করে আমরা মেনে নেব? অথচ ক্রিকেটের স্পিরিট নিয়ে ওরা এত কথা বলে!” ক্ষোভ যাচ্ছে না তাঁর। মাঠের মধ্যে স্লেজিং-পাল্টা স্লেজিংয়ে দু’দলের সম্পর্ক এমন উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে যে, নিরাপত্তার জন্য মুম্বই পুলিশের নামানো ট্যাঙ্ক না মাঠের মধ্যে ডাকতে হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য।
ক্রিকেট যেমন নেয়, তেমন আবার ফিরিয়েও দেয়। ইংল্যান্ড সফরে ধোনির ক্রিকেট ললাটলিখন ভারতে এসে তাঁর প্রতিপক্ষ অধিনায়কের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। চলতি সফরে প্রায় প্রত্যেক দিনই তাঁদের এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে যে, এতটা তফাত কী করে হচ্ছে? আর এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের তরফে সেরা উত্তরটা এ দিন দিয়ে গেলেন জোনাথন ট্রট। বললেন, “আমার মনে হয় ইংল্যান্ডের গ্রীষ্মে আমরা যে ক্রিকেট খেলেছি সেটা এখানে খেলতে পারছি না। আর ভারত ওখানে খেলতে পারেনি। এখানে ভাল খেলছে।” একদম সহজ-সরল বিশ্লেষণ। কিন্তু নানা গভীর তত্ত্ব আউড়ানোর মধ্যে মনে হচ্ছে, এটাই সবথেকে সঠিক বিশ্লেষণ।
কিন্তু ২ এপ্রিল-উত্তর ওয়াংখেড়েতে শুধুমাত্র ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণের খোঁজ আর কে করতে চায়? ওয়াংখেড়ে মানেই তো এখন দেশের ক্রিকেট আবেগ। আবার সেই ঐতিহাসিক ড্রেসিংরুম। কোনও বিরল ছবি ইতিমধ্যেই লাগল কি না দেখে আসা যাক। বাইরের দেওয়ালটাতেই তো সংবাদপত্রের কাটিং লাগানো আছে মনে হচ্ছে। নির্ঘাৎ ৩ এপ্রিলের হবে। কাছে গিয়ে দেখা গেল ভুল। চার-পাঁচটা কাগজের মধ্যে ক্রিকেটের পাতা একটাই। আর তাতে বড় করে ছবি কার? না, রাহুল দ্রাবিড়ের। শিরোনামে তাঁর মন্তব্য: আই অ্যাম নট দ্য ওয়াল! প্রাক-দিওয়ালি ওয়াংখেড়েতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, এটাই সবথেকে গভীর ছবি। ইংল্যান্ডে একা বুক চিতিয়ে লড়াই করা নায়ক। ২ এপ্রিলের ওয়াংখেড়েতে ছিলেন না। ২৩ অক্টোবরও থাকবেন না। কিন্তু নবীনরা ৫-০ করতে পারলে প্রবাসে প্রবীণের প্রত্যয়কেই সেই জয় উৎসর্গ করা উচিত! |