নিছক প্রথা মানলে তিনি লন্ডনের এক বর্গ মাইল এলাকার সাম্মানিক অধিকারী। কিন্তু সেই প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করার দাপট দেখিয়েই নিজের ‘অধিকারের অংশকে’ ব্যবসার ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলেছেন ‘সিটি অফ লন্ডন’-এর লর্ড মেয়র মাইকেল বেয়ার। শুধু অনুষ্ঠানের মঞ্চে ফিতে কাটার ভূমিকায় সন্তুষ্ট না-থেকে এলাকার দক্ষতাকেই মোড়ক দিয়েছেন পুরোদস্তুর উপদেষ্টা সংস্থার। এমন এক সংস্থা, যারা শুধু পরামর্শই দেয় না। ভেঙে পড়া শহরে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের লক্ষ্যে তার হাত ধরে থাকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা শহরকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রায় প্রতিটি ধাপে।
সম্প্রতি কলকাতায় পা রেখেছিলেন ব্রিটেনে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ‘সিটি অফ লন্ডন’-এর লর্ড মেয়র মাইকেল বেয়ার। বৈঠক করলেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে। জানালেন, ভগ্ন কলকাতাকে ফের নতুন করে গড়ার প্রস্তাব নিয়েই শহরে এসেছেন তিনি। এর পর একান্ত সাক্ষাৎকারে বেয়ার বলেন, “কলকাতাকে লন্ডন করে তুলতে সব থেকে আগে প্রয়োজন পরিকাঠামোর উন্নয়ন। তার জন্য চাই অর্থ। সেই অর্থের জোগান কী ভাবে মিলবে, তার পথ বাতলে দেবেন সিটি অফ লন্ডনের বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে টাকা তোলার পথ দেখাতে সাহায্য করবে সেখানকার আর্থিক (ফিনান্সিয়াল) সংস্থাগুলিও।”
কলকাতাকে লন্ডন করে তোলার স্বপ্নের কথা বার বারই বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই স্বপ্নের সূত্র ধরেই টেমস আর গঙ্গার পারের দুই শহরকে জুড়ে দিতে চান বেয়ার। কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান তিনি। এক দিকে কলকাতাকে ঢেলে সাজার উদ্যোগে সামিল হতে চায় চায় সিটি অফ লন্ডন। অন্য দিকে, এ ভাবেই নতুন বাজার খুঁজে গায়ে লেগে থাকা ‘ফিনান্সিয়াল হাব’-এর তকমা রক্ষা করতে চায় লন্ডনের বুকে জেগে থাকা এই এক বর্গ মাইল এলাকা। |
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক, সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, বিমা বহুজাতিক-সহ দুনিয়ার বহু তাবড় আর্থিক সংস্থার সদর দফতর কিংবা অন্যতম প্রধান দফতর রয়েছে বেয়ারের সিটি অফ লন্ডনে। বিশ্বে এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব কম, যার পৃথিবীজোড়া ব্যবসার মানচিত্রে সিটি অফ লন্ডন নেই। এ বিষয়ে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভবত নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন অফিস পাড়া। ইউরোপ জুড়ে আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে ‘নিজের এলাকার’ ব্যাঙ্ক কিংবা বিমা সংস্থাগুলির জন্য নতুন বাজারের খোঁজেই কলকাতা-সহ ভারতের শহরগুলিকে পাখির চোখ করছেন বেয়ার। যে কারণে ২০০৭-এর পর এই প্রথম সিটি অফ লন্ডনের লর্ড মেয়রের সফরসূচিতে দিল্লি ও মুম্বইয়ের পাশেই জায়গা করে নিয়েছে জোব চার্নকের শহর। তৎকালীন লর্ড মেয়র জন স্টুটার্ডের পর ফের শহরে এসেছেন বেয়ার।
নতুন করে শহর গড়ার দক্ষতা যে তাঁরা কলকাতাকে বিক্রি করতে চান, তা স্পষ্ট করে দিয়ে বেয়ার বলেন, “কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের পরিকাঠামো গঠনের সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতাপত্র সই করব আমরা। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে।”
বেয়ারের দাবি, শুধু পরামর্শ দেওয়া নয়। পরিকাঠামো গড়তে ঋণপত্র ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তোলার বিষয়ে সরাসরি সাহায্য করতে পারে সিটি অফ লন্ডনের ব্যাঙ্কগুলি। পরিকাঠামো গড়ার প্রকল্পেও শরিক হতে পারে সেখানকার বিভিন্ন সংস্থা। খোলা আছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সামিল হওয়ার পথও। এই ব্যবসায়িক মডেলের কথা মাথায় রেখেই প্রতিনিধিদলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের পাশাপাশি জেনসলার, আরুপ-এর মতো পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্থার কর্তাদেরও সঙ্গে এনেছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও চেন্নাইয়ে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণে ইতিমধ্যেই প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে জেনসলার। আর সিডনি অপেরা হাউসের ভিত ও কাঠামোর নকশা তৈরির কৃতিত্ব রয়েছে আরুপের ঝুলিতে।
কলকাতা পুনর্গঠনে আর একটি সূত্র হতে পারে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)-ও। এ রাজ্যের শিল্প, স্বাস্থ্য, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, শিক্ষা-র মতো ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে আগেই আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এই ব্রিটিশ সংস্থা। অর্থ জুগিয়েছে ২৬টি রাজ্য সরকারি সংস্থার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়। বেয়ার জানিয়ে গেলেন, অনুদান দেওয়ার সেই পরিচিত রাস্তা ছেড়ে এ বার ধার দিয়েই রাজ্যের কোনও প্রকল্পে অর্থ জোগাতে চায় ডিএফআইডি। |