বিশ্বাসযোগ্যতার ‘সূচক’ হিসেবে যাকে ধরা হয়েছে, তাতেই মিশেছে প্রতারণার জল!
ওজনে যাতে ক্রেতারা না-ঠকেন, তার জন্য সোনা-রুপোর গয়নায় ‘হলমার্ক’ ছাপ দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে। সে ছাপ দেখে গয়না কিনলে ওজনে ঠকার ভয় নেই। এমনটাই বলে থাকে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ‘ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডর্’ (বিআইএস)। অন্তত এত দিন বলে এসেছে।
কিন্তু এ হেন ‘নিরাপদ’ গয়নায় এ বার ভেজাল খুঁজে পেল বিআইএস-ই! কলকাতার কয়েকটি দোকানে সমীক্ষা করতে গিয়ে বিআইএস-অফিসারেরা দেখেছেন, ‘হলমার্ক’ গয়নায় যত সোনা আছে বলে দেখানো হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে থাকছে তার কম!
অতএব, ‘হলমার্ক’ প্রতীকের নির্ভরতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
এতে বিআইএস-কর্তৃপক্ষও যারপরনাই উদ্বিগ্ন। বিআইএসের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল দিলীপকুমার চৌধুরী বলছেন, “হলমার্ক গয়নায় উল্লিখিত সোনার পরিমাণ যথাযথ কি না, তা যাচাই করতে বিভিন্ন দোকানে মাঝেমধ্যে সমীক্ষা চালাই আমরা। সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার হলমার্ক সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কয়েকটি সোনার দোকান থেকে সংগ্রহীত গয়নার নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, দু’টো ক্ষেত্রে সোনার পরিমাণ গয়নার উপরে লেখা অঙ্কের চেয়ে কম!”
ব্যাপারটা তাঁদের বেশ চিন্তায় ফেলেছে বলে জানিয়েছেন দিলীপবাবু। তাঁর কথায়, “আমাদের আশঙ্কা, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা এ বার উত্তর ও মধ্য কলকাতার দোকান থেকে গয়না তুলে পরীক্ষা করব। কী ভাবে এমন কাণ্ড হল, তা বার করতেই হবে।”
হলমার্কে ভেজাল দেওয়া কী ভাবে সম্ভব?
দিলীপবাবু জানাচ্ছেন, দোকানের মালিক যে সমস্ত গয়নায় ‘হলমার্ক’ দিতে চান, সেগুলো বিআইএস-অনুমোদিত পরীক্ষাকেন্দ্রে (অ্যাসেসিং সেন্টার) পাঠানো হয়। ক্যারেট অনুপাতে সোনার পরিমাণ পরীক্ষা করে গয়নায় হলমার্কের ছাপ দেওয়া হয়। সেই পরীক্ষা করানোর খরচ বাবদ অলঙ্কার বিক্রেতা সংস্থাগুলোর তরফে টাকাও দিতে হয়। কলকাতায় এমন দশটা পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সব ক’টাই বেসরকারি।
এবং এগুলোরই কোথাও এই জালিয়াতি হয়ে থাকতে পারে বলে বিআইএসের প্রাথমিক অনুমান।
রাজ্যের ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরেরও এক অফিসারও বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় সোনা-রুপোর মান-পরিমাণ যাচাই করে হলমার্ক ছাপ দেওয়ার কোনও সরকারি পরীক্ষাকেন্দ্র নেই। ফলে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী কোনও বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে আঁতাত করে থাকতেই পারেন।”
স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটির হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার অলঙ্কার বিক্রির দোকান রয়েছে। একটা সময়ে হলমার্ক ছাড়াই বাজারে সোনা-রুপোর গয়না বিক্রি হতো। ক্রেতা-সুরক্ষার স্বার্থেই ২০০০ সাল থেকে রাজ্যে গয়নায় ‘হলমার্ক’ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে তা বাধ্যতামূলক না-হওয়ায় এখনও বহু দোকান হলমার্ক ছাড়াই গয়না বেচে। রাজ্যে এখন সাড়ে ন’শোর মতো সোনার দোকান হলমার্কের সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যবসা করছে, যেগুলোর অধিকাংশই কলকাতায়। হলমার্ক সার্টিফিকেট বাবদ কলকাতার বিক্রেতাদের তিন বছরের জন্য মোট ২৫ হাজার টাকা ফি দিতে হয়।
কিন্তু সেই হলমার্কেই এ হেন জল মেশানোর প্রবণতা সম্পর্কে স্বর্ণ-ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?
স্বর্ণশিল্প বাঁচাও কমিটি’র অন্যতম সদস্য প্রদীপ ঘোষের মতে, হলমার্ক গয়নায় এমন ভেজাল দেওয়াটা মোটেই কাম্য নয়। তাঁর বক্তব্য, “বিআইএস-অনুমোদিত বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোয় গয়নার সঠিক মান নির্ধারণ হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।”
বস্তুত, এ প্রসঙ্গে নজরদারির ‘শৈথিল্যের’ জন্য বিআইএসের দিকেও আঙুল তুলছেন তাঁরা।
|
মার্কা-বৃত্তান্ত |
হলমার্ক কী • গয়নায় সোনা বা রুপোর সঠিক পরিমাণজ্ঞাপক ছাপ।
• দেয় ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস(বিআইএস)।
• গয়নায় সোনার পরিমাণ বোঝানো হয় ২৪, ২২
বা ১৮ ক্যারেট হিসেবে।
(২৪ ক্যারেট মানে ১ গ্রামে পুরোটা সোনা। ২২ ক্যারেট মানে ৯১৬ মিলিগ্রাম সোনা।
১৮ ক্যারেট মানে ৭৫০ মিলিগ্রাম সোনা।)
‘হলমার্ক’ নামের উৎপত্তি • সোনা-রূপোর সঠিক ওজন সম্পর্কে এই ‘নির্ভরতাসূচক’ ছাপটি তৈরি হয়
১৭২১-এ, লন্ডনের ‘গোল্ডস্মিথস হল’ প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত স্বর্ণশিল্পী সম্মেলনে।
তাই নাম হলমার্ক।
চেনার উপায়
• গয়নার গায়ে বিআইএসের নির্দিষ্ট মার্কা দেখা যাবে আতস কাচ দিয়ে। ‘হলমার্ক’ চিহ্নিত
গয়নায় ক্যারেটের উল্লেখের সঙ্গে ওজন পরীক্ষক সংস্থা ও নির্মাতা দোকানের ছাপ থাকবে।
ছাপ কোন বছরের, তা বোঝাতে নির্দিষ্ট কোড আছে। যেমন, ২০১১-র হলে ‘N’ লেখা থাকবে। |
|