|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
মূল্যবোধের ভাঙনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ‘অ্যান্টিভাইরাস’ দলের প্রথম সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
কলকাতায় আর একটি নতুন শিল্পী-দল সংগঠিত হল। নাম ‘অ্যান্টিভাইরাস’। এতে রয়েছেন ছ’জন সদস্য। চার জন চিত্রী - স্বপনকুমার মল্লিক, অনিন্দ্য পণ্ডিত, সুজাতা পণ্ডিত ও দিবাকর কর্মকার। এক জন ভাস্কর, দীপঙ্কর দত্ত। এ ছাড়া রয়েছেন শর্মিষ্ঠা মাইতি। সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল এই দলের প্রথম সম্মেলক প্রদর্শনী ‘হোয়েন থিংস ফল অ্যাপার্ট’।
দলের নাম ও প্রদর্শনীর শিরোনাম দু’টি শিল্পীদের প্রকাশের অভিমুখের কিছু ইঙ্গিত আনে। শর্মিষ্ঠা তাঁর লেখায় তা বলেছেন। চারপাশের বাস্তব যেমন, তেমনই শিল্পের পরিমণ্ডলও ইদানীং ভীষণ ভাবে জীবাণুক্লিষ্ট হয়ে উঠছে। বলা যেতে পারে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে সংহতি হারাচ্ছে সব কিছু। মূল্যবোধের এই ভাঙনই শিল্পীদের সচেতন করছে। তাঁদের ভিতর প্রতিবাদী চেতনা জাগাচ্ছে। কোথাও কোনও অত্যাচার, অনাচার বা সংকট ছিল না। কিন্তু বর্তমান উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে যখন বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বকে একটি ভুবনগ্রামে রূপান্তরিত করতে চাইছে, তখন পুঁজির বিস্তারের দাপট সমস্ত জীবনের মধ্যে যে ভাইরাস ছড়াচ্ছে, তার কোনও তুলনা পূর্ববর্তী যুগে ছিল না। সংকট শুধু জীবনে নয়, শিল্পের প্রকাশেও। আলোচ্য প্রদর্শনীতে শিল্পীরা সেই সংকটকে মোকাবিলা করতে চেয়েছেন তাদের নিজেদের মতো করে। তাঁদের মধ্যে অবশ্য তত্ত্বগত বা আঙ্গিকগত কোনও ঐক্য নেই। সংকট নিয়ে ভাবনাও সকলের কাজের একমাত্র লক্ষ্য বা প্রস্থান বিন্দু নয়। সে দিক থেকে দলের ঐক্যের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি খুব দৃঢ় নয়। কিন্তু সকলেই নিষ্ঠা সহকারে তাঁদের জীবনবোধকে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন।
ভাস্কর দীপঙ্কর দত্ত তাঁর ন’টি নানা মাধ্যমের ভাস্কর্যে আঙ্গিকের কোনও নতুন অভিমুখ দেখাননি। ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত আমাদের ভাস্কর্যে পাশ্চাত্য আধুনিকতা-নির্ভর যে প্রকাশভঙ্গি ছিল, তাঁর কাজগুলি সেই পরিসীমার মধ্যেই রয়ে গেছে। ‘মাদার’ বা ‘হ্যাম-ফিস্টেড’ শীর্ষক রচনাগুলিতে হেনরি মুরের আঙ্গিক পদ্ধতিকে তিনি নিজের মতো করে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর ‘বায়োমর্ফিক’ বা জীবনভিত্তিক প্রতিমাকল্পের মধ্য দিয়ে তিনি কিন্তু রূপের এক সৌন্দর্যলিপ্ত উত্তরণেরই স্বপ্ন দেখেছেন। সংকট ততটা নয়।
সংকট সবচেয়ে বেশি ঘনীভূত হয়ে উঠেছে স্বপনকুমার মল্লিকের ছবিতে। তাঁর কল্পরূপাত্মক, খানিকটা সুররিয়ালিস্টধর্মী ন’টি ছবিতে তিনি দৃশ্যমান বাস্তবতার সমস্ত পরিমণ্ডল ভেঙে শরীরী কামনা বা যৌনতার তীব্র দহনকে প্রতীকায়িত করেছেন। ‘মোর দ্যান উই আর’ শীর্ষক সিন্থেটিক টেম্পারার ছবিটিতে দুই হাতল বিশিষ্ট একটি কফি কাপের উপর লেখা রয়েছে ‘এক দিন সকালে
উঠে দেখি আমার
কফি কাপের
দুটি হাতল
তাই কফিতে চুমুক না দিয়ে......’।
নারী ও পুরুষের দুটি হাত দু’ দিক থেকে সেই কাপটি ধরেছে। তলায় টেবিলের উপর মোবাইল, সিগারেটের প্যাকেট, সাপ-লুডো ইত্যাদি। এই সংকটের ভিতর তিনি একটি ধ্যানের কেন্দ্রও খোঁজেন। ‘দ্য বুদ্ধ উইদিন মি’ ছবিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে। |
|
শিল্পী: অনিন্দ্য পণ্ডিত |
অনিন্দ্য পণ্ডিতের ছবিতেও এই সংকটের পরিমণ্ডল আছে। কিন্তু তা অনেক অন্তর্মুখী। ‘সেলিব্রেটিং বার্থ ডে’ শীর্ষক সাতটি ছবিতে ছায়াচ্ছন্ন প্রতিমাকল্পের ভিতর দিয়ে দৈনন্দিন জীবন যাপনের অন্তর্গত নিহিত শূন্যতাকে তিনি বের করে আনতে চেয়েছেন। চারপাশের জীবন থেকে উঠে আসা ব্যক্তির এই আত্মগত সংকট করুণ সুরের মতো বাজছে।
সুজাতা পণ্ডিতের ‘রিমেমবারিং রেবেকা’ শীর্ষক জলরঙে আঁকা নটি অত্যন্ত বর্ণিল ছবিতে নারীর আত্মগত সংকট রূপায়িত হয়েছে। ‘রেবেকা’ একটি প্রতীকী নাম। হয়তো শিল্পীর নিজেরই আত্মপ্রক্ষেপ। সুজাতার সন্ধানে ঐকান্তিকতা আছে। কোথাও কোথাও অনিয়ন্ত্রিত আবেগ তাঁর ছবির সংহতিকে ব্যাহত করেছে।
দিবাকর কর্মকারের আঁকা বড় বিমূর্ত ক্যানভাস জীবনের সমস্ত সংকটকে অতিক্রম করে এক প্রদীপ্ত আলোর ইশারা আনে। নিসর্গ থেকে রূপান্তরিত তার ছবিগুলি বলে, জীবনের সমস্ত হিংসা ও সন্ত্রাস পেরিয়ে কোথাও প্রকৃতির মধ্যে এক আলোর ইঙ্গিতও রয়ে গেছে। |
|
|
|
|
|