এ যেন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে!
রাজ্যের যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা কেমন চলছে, তা জানতে একটি জেলায় তদন্তে গিয়েই চোখ কপালে উঠেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। তদন্তে জানা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁর বিস্তীর্ণ এলাকার যক্ষ্মা রোগীদের বেশির ভাগ তথ্যই অফিসে বসে ‘মন থেকে’ তৈরি করা। বছরের পর বছর সেই ‘মনগড়া’ তথ্যই পাঠানো হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরে। তার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে ওই এলাকার যক্ষ্মা সংক্রান্ত যাবতীয় নীতি ও পরিকল্পনা।
এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে স্বাস্থ্যকর্তারা হয়তো এতটা আতঙ্কিত হতেন না। কিন্তু রাজ্যের সর্বত্রই যে কমবেশি একই কাণ্ড চলছে, সে ব্যাপারে তাঁরা যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। কিন্তু তাঁদের কিছু ‘করার নেই’। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা থেকে শুরু করে অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (যক্ষ্মা), সকলের মুখেই এই এক কথা। কেউ কেউ অবশ্য এর জন্য দায়ী নজরদারি পরিকাঠামোর খামতিকে। তদন্তকারী অফিসারদের বক্তব্য, যে ভাবে এক জন অস্থায়ী কর্মীর উপরে বিস্তীর্ণ এলাকায় নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে এ রকম ভুল তথ্য আসতে বাধ্য।
সপ্তাহ তিনেক আগে খোদ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন রাজ্যে যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং ওই রোগের চিকিৎসা যথেষ্ট পরিমাণে ছড়িয়ে দিতে না পারার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
তার পরেই স্বাস্থ্যকর্তাদের এই ‘উপলব্ধি’ এত দিন ধরে যক্ষ্মা নিয়ে সরকারের যাবতীয় প্রচারের মুখে কার্যত চুনকালি লাগিয়ে দিয়েছে। খোদ স্বাস্থ্যকর্তারাই সে কথা মনে করছেন।
যক্ষ্মা বিভাগের কর্তারা জানিয়েছেন, উত্তর ২৪ পরগার বনগাঁ যক্ষ্মা ইউনিটের এক সিনিয়র ট্রিটমেন্ট সুপারভাইজার (এসটিএস) গোপাল ভট্টাচার্যের উপর প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ জনবসতিযুক্ত এলাকার যক্ষ্মা রোগীদের চিহ্নিত করা ও ‘ডটস’ পদ্ধতিতে তাঁদের চিকিৎসায় তদারকির দায়িত্ব ছিল। অভিযোগ, তিনি কোনও নজরদারি চালাননি, ওষুধও দেননি। উল্টে যক্ষ্মা রোগীদের নাম, তাঁদের কফের রিপোর্ট, ওষুধ খাওয়ার ফিরিস্তি, তাঁরা ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছেন কি না সেই তথ্যের অধিকাংশই নিজের মনের মতো করে বানিয়ে খাতায় লিখে দিয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারেরা জানিয়েছেন, গোপালবাবুর টেবিলের ড্রয়ার থেকে যক্ষ্মা রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ইঞ্জেকশন মিলেছে। সেগুলি ফ্রিজে না-রাখলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ওই ওষুধ ও ইঞ্জেকশন খাতায় কলমে রোগীদের দেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। শাস্তি হিসাবে গোপালবাবুর নামে জেলাশাসকের অফিস থেকে বনগাঁ থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।
রাজ্যের অন্যত্র চিত্রটা কেমন?
রাজ্যের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (যক্ষ্মা) শ্যামাপদ বসাকের বক্তব্য, “আমরা জানি, অন্য জেলাতেও একই রকম জোড়াতালি দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিন্তু সেখানে অভিযান চালাবে কে? লোক কোথায়? ডটস কার্যক্রমে নজরদারি বাড়াতে যে লোকবল দরকার, তার সিকিভাগও কোনও জেলায় দেওয়া হয়নি।” তিনি জানান, এক-এক জন এসটিএস-কে প্রায় ছয়-সাত লক্ষ জনবসতি এলাকার সব যক্ষ্মা রোগীর চিকিৎসার তদারকি করতে হয়। বিনিময়ে ওই অস্থায়ী কর্মীদের মাসে ১২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব ব্যবস্থা। চাকরি বাঁচাতে মরিয়া হয়েই তাঁরা মিথ্যা তথ্য নথিভুক্ত করছেন।
সমস্যার অন্য দিকও রয়েছে। সেটা উঠে এসেছে অস্থায়ী এসটিএস-দের কথা থেকে।
জলপাইগুড়ির এক এসটিএসের বক্তব্য, “স্বাস্থ্য-সহায়কদের মাধ্যমে আমাদের ওষুধ খাওয়াতে হয়। তাঁরা স্থায়ী কর্মী। আমাদের মতো অস্থায়ী কর্মীদের তাঁরা তোয়াক্কাই করেন না।” মালদহের এসটিএস সুদীপ্ত দাস জানান, রোজ ৪৫ কিলোমিটার এলাকার ৭০টি সাব সেন্টারে ডটসের চিকিৎসার তদারকি করতে হয়। তাঁর প্রশ্ন, “এত বড় এলাকায় কে ওষুধ খেল, কার ওষুধ বাকি, কার ওষুধ কাজ করছে না, এত সব তথ্য সংগ্রহ কি এক জনের পক্ষে করা সম্ভব?” মালদহেরই অন্য এক এসটিএসের আবার অভিযোগ, “ডটস প্রকল্পের অনেক চিকিৎসকই আমাদের খাতায়কলমে তথ্যে জল মেশাতে বলেন। তাঁদের কথামতো লিখতে হয়, ওষুধ খেয়ে ৯০ শতাংশ রোগী ভাল হয়ে গিয়েছেন।”
পোলিও-তেও বহু ক্ষেত্রেই ঘরে ঘরে গিয়ে খাওয়ানো হয়। সেখানে ‘সাফল্য’ অনেক বেশি। তা হলে যক্ষ্মার ক্ষেত্রে এই দুরবস্থা কেন? এই প্রশ্ন উঠলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানাচ্ছেন, যক্ষ্মার স্বাস্থ্য-সহায়কদেরই অনেক ক্ষেত্রে পোলিও-র কাজও করতে হয়। করতে হয় টিকাকরণের কাজও। ফলে তাদের পক্ষে তাই সব দিক রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যাহত হয় যক্ষ্মার কর্মসূচি।
এখন প্রশ্ন, মিথ্যে তথ্যের উপর ভিত্তি করেই কি রাজ্যের যক্ষ্মা চিকিৎসা চলতে থাকবে?
এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা শুভময় দত্তচৌধুরীর উত্তর, “সবই জানি। সমাধানসূত্র বার করার চেষ্টা চলছে।” |