|
|
|
|
রাজনৈতিক ‘মাতব্বরি’ না মানার হুঁশিয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
উন্নয়নের প্রশ্নে কোনও রাজনৈতিক ‘মাতব্বরি’ বরদাস্ত করা হবে না। সে তাঁর নিজের দল তৃণমূলের তরফে করা হলেও। বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে সাফ জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সদর দফতরে আলিপুর পুলিশ লাইনের কনফারেন্স রুমে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের বৈঠকে ‘রাজনৈতিক বাধা’র কথা ওঠে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানতে চান, ‘বাধা’ কি তৃণমূল দিচ্ছে? ইতিবাচক জবাব শুনে তখনই মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, উন্নয়নে কোনও ‘রাজনৈতিক মাতব্বরি’ বরদাস্ত করা হবে না। বৈঠকে উপস্থিত তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি তথা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার দফতরের প্রতিমন্ত্রী চৌধুরী মোহন জাটুয়াকে দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক আধিকারিকদের বলেন, কোনও সমস্যা হলে তাঁরা যেন ওই দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তা হলেই বিষয়টি তিনি জানতে পারবেন। উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মাতব্বরি তিনি সহ্য করবেন না। প্রশাসনিক আধিকারিকরাও যেন তা না-করেন।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, তিনমাস পর তিনি আবার জেলায় উন্নয়নের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে আসবেন। তখনও এই ধরনের অভিযোগ যেন না-পাওয়া যায়। আর তিনমাসের মধ্যে ‘মাতব্বরি’র বিষয়ে শোভন-জাটুয়ার কাছে অভিযোগ করেও ফল না-পাওয়া গেলে তা-ও যেন তাঁকে ওই বৈঠকে জানানো হয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তৃণমূলের ‘আধিপত্য’ প্রশ্নাতীত। পরপর কয়েকটি বিধানসভা ও লোকসভা ভোটে ভাল ফল করা তো বটেই, এই জেলায় জেলা পরিষদও গত পঞ্চায়েত ভোটে দখল করেছিলেন মমতা। ‘প্রশাসক’ হওয়ার সুবাদেই ওই জেলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে বেশকিছু দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আধিকারিকদের তরফে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ওই ‘অনুযোগ’ এবং তার জবাবে মমতার ‘হুঁশিয়ারি’ যথেষ্টই ‘গুরুত্বপূর্ণ’। |
|
প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: অশোক মজুমদার। |
প্রসঙ্গত, বুধবারেই উত্তর ২৪ পরগনায় একই ধরনের বৈঠকে মমতা সিপিএম পরিচালিত জেলা পরিষদের সভাধিপতিকে না-ডাকায় বিরোধী শিবিরে তা নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। প্রশ্নও উঠেছিল, সভাধিপতি নিজের দলের নয় বলেই উত্তর ২৪ পরগনায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ডাকেননি। এ দিনের বৈঠকে অবশ্য স্পষ্ট, ‘নিজের দল’ ক্ষমতাসীন থাকলেও তাদেরও খুব একটা ছেড়ে কথা বলতে রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষত, উন্নয়নের প্রশ্নে। ঘটনাচক্রে, রাজ্যে পালাবদলের পর দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সিপিএম ছেড়ে অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। জেলার রাজনীতিতে যা ‘লাল-তৃণমূল কংগ্রেস’ বলে পরিচিত। তারা যে বিভিন্ন ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তা-ও তাঁর নজরে এসেছে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সম্প্রতি যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রে ‘লাল-তৃণমূল কংগ্রেস’-এর কয়েকটি উৎপাতের ঘটনাও মুখ্যমন্ত্রীর কানে এসেছে। তিনি যে তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের থেকেও ওই রকম কোনও ‘বিশৃঙ্খলা’ বরদাস্ত
করবেন না, এ দিনের বৈঠকে প্রশাসনিক আধিকারিদের সেই বার্তাও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এ দিনের বৈঠকে গঙ্গাসাগরের তীর্থকর ‘মকুব’ করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী নেত্রী হিসেবে বার বার তিনি গঙ্গাসাগর মেলায় তীর্থকর মকুবের দাবি জানিয়েছিলেন। জেলা পরিষদে ক্ষমতায় আসার পর সেই দাবি আরও জোরালো হয়। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তীর্থকর মকুব করেনি। এ দিন বৈঠক চলাকালীন জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগমকে মুখ্যমন্ত্রী তীর্থকর বাবদে আয়ের পরিমাণ জানতে চান। জেলাশাসক জানান, ১২ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। এরপরই ওই কর মকুব করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে সমস্ত দিক দিয়েই রাজ্যের মানচিত্রে তুলে ধরার উপর জোর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার মধ্যে যেমন রয়েছে সুন্দরবনের পর্যটনকে ‘আফ্রিকান সাফারি’র ধাঁচে গড়ে তোলা, তেমনই রয়েছে চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে বিশেষ নির্দেশও। বৈঠকে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শিখা অধিকারীকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জেলার স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল। চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। জেলায় সর্বস্তরের হাসপাতালেই পরিষেবার মান বাড়াতে হবে।
একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বিষয়ে জেলাশাসককে মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞাসা করেন, মাসে কত দিন কাজ দেওয়া হচ্ছে। জেলাশাসক জানান, ১৭ দিন। কাজের দিনের সংখ্যা আরও বাড়াতে পরামর্শ দেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলা আধিকারিকদের বলেন, ‘অপুষ্টিজনিত’ কারণে কেউ মারা গেলে কিন্তু প্রশাসনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। তিনি সংশ্লিষ্ট কাউকে ছাড়বেন না। জেলার পুলিশ সুপার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনাকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তাঁর অফিসারদের নজরে অপুষ্টিজনিত কোনও বিষয় এলে যেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সঙ্গে সঙ্গে তা জানানো হয়। অফিসারদের বলেন, তাঁরা যেন অফিসে বসে না-থেকে এলাকায় ঘোরেন। নিজের উদাহরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অফিসারদের বলেন, তিনি নিজে জেলায় ঘুরলে অনেক কিছু দেখতে পান। অফিসাররা কেন তা পান না?
সংখ্যালঘুদের আবাসন ও গ্রামীণ বিদ্যুদয়নের উপর বিশেষ জোর দেওয়া, তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির শংসাপত্র তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক কর্তাদের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের সংস্কারে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। তা ছাড়া সাগরে কয়েকদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। সুন্দরবন এলাকায় পর্যটন কেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।” উত্তরের মতোই দক্ষিণেও জেলাশাসক, মহকুমাশাসক ও ব্লক আধিকারিক স্তরে ‘সমন্বয় কমিটি’ তৈরি করা হয়। ঠিক হয়েছে, সাতদিন অন্তর কমিটি বৈঠকে করবে। উন্নয়নের গতি বাড়াতে ওই কমিটি নজরদারি চালাবে।
বৈঠকে রাজনৈতিক ‘মাতব্বরি’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অভয়’ পেয়ে আধিকারিকরা প্রত্যাশিত ভাবেই উৎসাহিত। তাঁদের একাংশ বলেন, “সমন্বয় কমিটি হওয়ার ফলে অনেক কাজ দ্রুত এগোবে। ফাইল দিনের পর দিন পড়ে থাকবে না। বিভিন্ন দফতরে জট তাড়াতাড়ি কাটবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসে বৈঠক করলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবিধা-অসুবিধাগুলি সরাসরি তাঁকে জানানো যাবে। এতদিন যা ঊর্ধ্বতন কর্তাদের মর্জির উপর নির্ভর করত।” |
|
|
|
|
|