|
|
|
|
ইংরেজদের চুনকাম করার দিকে ধোনিরা |
সুমিত ঘোষ • চণ্ডীগড় |
ইংল্যান্ডের কালা সফর থেকে ধোনির ভারতের বিধ্বস্ত হয়ে ফেরা। আর দেশের মাটিতে নেমে কুকের ইংল্যান্ডকে পাল্টা কালা সফরের দিকে ঠেলে দেওয়া। মাঝে মাত্র এক মাসের ব্যবধান। অথচ কত দ্রুতই না পাল্টে গেল চার দিকের আবহ।
১৮ সেপ্টেম্বর ধোনি বাহিনী সর্বস্বান্ত হয়ে বিলেত থেকে ফিরল। সারা গায়ে তখন তাঁদের ০-৮ কেলেঙ্কারির লজ্জা মাখা। চারটে টেস্টের চারটেতেই হেরে টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বরের মুকুট হারিয়েছে। যে তিনটে এক দিনের ম্যাচ হয়েছে, তিনটেতেই হেরেছে। একমাত্র টি-টোয়েন্টি হেরেছে। গোটা সফরে একটাও জয় নেই। ধোনিদের দেশে ফেরার দিনকার কয়েকটি ওয়েবসাইট খুলে ক্রিকেটভক্তদের মন্তব্যগুলো ফের দেখে নেওয়া গেল।
কেউ বোর্ড প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে লিখেছেএই বিপর্যয়ের উত্তর দিন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সাহেব! কেউ আরও লিখেছে, আইপিএল আর টাকা কামানোর দিকেই এদের বেশি লক্ষ্য। দেশের কথা ভাবেই না। তোপের মুখে ক্রিকেটারেরা। সচিন তেন্ডুলকরও বাদ যাচ্ছেন না। ক্ষুব্ধ ক্রিকেটভক্ত বোর্ডকে পরামর্শ দিচ্ছে, সচিনকে এ বার ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলুন। কেউ ক্যাপ্টেনের মুকুট ধরে টানাটানি করছে। কেউ বোলারদের চিরনির্বাসনে পাঠাতে চায়। রীতিমতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। উত্তেজিত ক্রিকেট-জনতার কাছে একমাত্র বন্দিত নায়ক কোনও এক রাহুল দ্রাবিড়। |
|
মোহালিতে রাহানে-রাজ। ছবি: উৎপল সরকার |
আর ২০ অক্টোবরের মোহালিতে কী দেখছি? না, সেই সব ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদেরই এক জন সারা গায়ে তেরঙ্গা এঁকে গ্যালারিতে বসা। বুকের উপর বড় বড় করে লেখা ‘ধোনি’। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিনি আক্রান্ত অধিনায়ক থেকে আবার আরাধ্য অধিনায়ক। রাহুল দ্রাবিড়? গোটা স্টেডিয়ামে সারা দিনে এক বারও উচ্চারিত হয়েছেন কি না সন্দেহ। ইয়ে ইন্ডিয়া হ্যায় ভাই!
ইংল্যান্ডে ভারতীয় ক্রিকেট যখন পুড়ছে, তখন কেউ মনে রাখেনি ধোনির এই টিমই মাত্র পাঁচ মাস আগে ওয়াংখেড়েতে স্বপ্নের রাত উপহার দিয়েছে। বিশ্বকাপের সেই সময় এই মোহালিতে আফ্রিদিদের হারিয়ে ওয়াংখেড়ের ফাইনালের টিকিট ‘বুক’ করেছিলেন ধোনিরা। সেখানেই বদলার সিরিজ ৩-০ জেতার দিকে যখন এগোচ্ছে ধোনির টিম, তখনও কেউ মনে রাখল না, মাত্র এক মাস আগে এরাই বিপর্যস্ত হয়ে ফিরেছে! ইয়ে ইন্ডিয়া হ্যায় ভাই!
মাস দেড়েক আগের ওভালে কেউ যদি ম্যাচের ফার্স্ট হাফটা মিস করে যেত আর তাকে কেউ বলত, ধোনিদের ২৯৯ তাড়া করতে হবে, সে নির্ঘাত ওখানেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। বলে দিত, ম্যাচ দেখে আর লাভ নেই। যে টিম ২০০ তুলতে পারছে না, তারা ৩০০ কী তাড়া করবে! এখানে সে সবের চিহ্ন নেই। দুপুর থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাটিংয়ের সময় মোহালির মাঠ প্রায় আর্ধেক খালি পড়ে থাকল। আর পার্থিব পটেল-অজিঙ্ক রাহানে জুটি যখন ড্রেসিংরুম থেকে ব্যাট হাতে বেরোচ্ছেন, মাঠ প্রায় ভর্তি। ইয়ে ইন্ডিয়া হ্যায় ভাই! |
|
‘ক্যাপ্টেন, হ্যাটস অফ’। সিরিজ জয়ের পর সেটাই কি ধোনিকে বলছেন কোচ ফ্লেচার? ছবি: উৎপল সরকার |
প্রবাসে যেটা ভয়ের স্কোর ছিল, নিজের দেশের নিশ্চিন্ত উঠোনে সেটা খুব বেশি হলে লড়াইয়ে ফেলতে পারে। তার বেশি আতঙ্কের কিছু নয়। এখন পর্যন্ত সিরিজের সর্বোচ্চ টার্গেটের সামনে পড়েও যেমন প্রথম উইকেটে পার্থিব পটেল আর অজিঙ্ক রাহানে ১৬ ওভারের মধ্যে ৭৯ তুলে দিলেন। তাই দেখে মোহালি আবার উৎসবের মোহালি হতে শুরু করল। মেক্সিকান ওয়েভ আছড়ে পড়তে শুরু করল। পোস্টার তুলে ধরা হচ্ছে ‘উই ওয়ান্ট ৫-০’। গ্যালারির যে দিকে তাকাও তেরঙ্গায় ভরে গিয়েছে। ইয়ে ইন্ডিয়া হ্যায় ভাই!
পার্থিবকে বিতর্কিত আউট দিলেন ভারতীয় আম্পায়ার সুধীর আসনানি। একা পার্থিব নন, অন্তত আরও তিনটে গড়বড়ে আউট তিনি দিলেন। কোনও ক্ষেত্রেই ব্যাটসম্যানকে প্রসন্ন দেখায়নি। ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের সময় কুক আর পিটারসেন। ভারতের বেলায় পার্থিব আর বিরাট কোহলি। গম্ভীরের সঙ্গে দ্বিতীয় উইকেটে রাহানে যোগ করলেন ১১১ রান। রাহানে ইংল্যান্ডেই দাগ কেটেছিলেন। এখানে বুঝিয়ে দিলেন, সৌরভের মতো প্রাক্তন তাঁকে নিয়ে লিখে ভুল করেননি। দুর্ভাগ্য তাঁর, জীবনের প্রথম সেঞ্চুরির মুখ থেকে ফিরতে হল। ১০৪ বলে ৯১ নিশ্চিত ভাবেই এক দিনের দলে অন্তত তাঁর জায়গা অনেকটা পাকা করে দিয়ে গেল। |
|
যুগলবন্দি: ভারতকে টানলেন গম্ভীর এবং রাহানে। ছবি: এপি |
কিন্তু গম্ভীর আর রাহানে বিদায় নিতেই আচমকা মেঘলা আকাশ তৈরি হয়ে গেল আজই সিরিজ জিতে নেওয়ার সম্ভাবনার উপর। ২৩ রানের মধ্যে দ্রুত তিনটে উইকেট চলে গেল। সেখান থেকে নড়বড়ে জাহাজের হাল ধরলেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’। রবীন্দ্র জাডেজাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দলকে পৌঁছে দিলেন সিরিজ জয়ের কাঙ্খিত স্টেশনে। তাঁর ৩১ বলে ৩৫ রানের ইনিংস মোহালিতে কোনও অঘটন ঘটতে দিল না। ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ জয়ের মতো স্বপ্ন সফল করেও উচ্ছ্বাস দেখাননি ধোনি। শুধু ওভার বাউন্ডারিটা মেরে বন্দুকবাজের ঢংয়ে এক বার ব্যাটটাকে নাচিয়েছিলেন। এখানে সিরিজ জিতে ড্রেসিংরুমের দিকে ফিরে এক বার হাতটাকে মুঠো করে ঝাঁকালেন। স্টেপ ওয়ান সম্পন্ন হল। এ বার বাকি দুই ম্যাচ জিতে ৫-০ করাটা স্টেপ টু।
উপরের ভিআইপি বক্সে দেশপ্রেম আজাদকে পাওয়া গেল। কপিলের কোচ জোর গলায় তখন তারুণ্যের স্লোগান আউরে যাচ্ছেন। বললেন, “আশিস নেহরাকে খেলিয়ে কী লাভ? চোট পেয়ে টিমকে ডুবিয়ে ছাড়বে। তার চেয়ে এই ছেলেগুলোকে খেলাও না বাবা। এই যে ছেলেটা, কী যেন নাম...উমেশ যাদব। ঘণ্টায় নব্বই মাইল বেগে বল করেছে। বিনয় কুমার ভাল সুইং করাচ্ছে। প্রবীণ কুমার ভাল সুইং করাচ্ছে। রাহানে ছেলেটা এত ভাল ব্যাট করে গেল। আমাদের এখন সামনের দিকে তাকানো উচিত।”
|
তারুণ্যের হাত ধরে বদলা |
• বিরাট কোহলি: তিন ম্যাচে রান ১৮৪, সর্বোচ্চ ১১২ নট আউট। গড় ৯২ , স্ট্রাইকরেট ৯৬.৩৩ |
• আজিঙ্ক রাহানে: তিন ম্যাচে ১২০ রান, সর্বোচ্চ ৯১। গড় ৪০, স্ট্রাইকরেট ৭৫। |
• রবিচন্দ্রন অশ্বিন: তিন ম্যাচে ১৩৬ রান দিয়ে চার উইকেট। সেরা বোলিং ৩-৩৫। ইকনমি রেট ৪.৮২। |
• বিনয় কুমার: তিন ম্যাচে ১১৮ রানে পাঁচ উইকেট। সেরা বোলিং ৪-৩০। ইকনমি রেট ৫.১৩। |
|
ধোনিদের সিরিজ-জয় উত্তর মোহালিতে দাঁড়িয়ে আবার মনে হচ্ছে, তারুণ্য বনাম অভিজ্ঞতা এখন কোনও তর্কই নয়। আসল তর্ক হচ্ছে, ক্রিকেটে নতুন ‘ট্রেন্ড’ এসে পড়ল কি না! ইংল্যান্ডে ইংল্যান্ড রাজ করবে। তখন তারা এক নম্বর। ভারতে এলে তাদের বিপর্যস্ত দেখাবে। তখন আবার ভারত রাজ করবে। কোনও ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়া কি আদৌ আর পাওয়া সম্ভব? যারা সব দেশে, সব পরিবেশে নিজেদের কর্তৃত্বের পতাকা উড়িয়ে দিতে পারবে? হয়তো ভবিষ্যতই জবাব দেবে। আপাতত প্রাক-দিওয়ালির মোহালিতে স্লোগান ওটাই।
‘ইয়ে ইন্ডিয়া হ্যায় ভাই’!
|
মোহালি ম্যাচের স্কোর |
ইংল্যান্ড |
কুক এলবিডব্লিউ বো বিনয় ৩
কেইসওয়েটার বো কোহলি ৩৬
ট্রট ন:আ: ৯৮
পিটারসেন এলবিডব্লিউ জাডেজা ৬৪
বোপারা বো প্রবীণ ২৪
পটেল ন:আ: ৭০
অতিরিক্ত ৩
মোট ৫০ ওভারে ২৯৮-৪
পতন: ৮, ৫৩, ১৫৪, ১৯৫।
বোলিং: প্রবীণ ১০-০-৫৬-১, বিনয় ৯-১-৬৪-১, কোহলি ৩-০-২০-১,
যাদব ১০-০-৭১-০, অশ্বিন ১০-০-৪৫-০, জাডেজা ৮-০-৪১-১। |
ভারত |
পার্থিব এলবিডব্লিউ ব্রেসনান ৩৮
রাহানে ক কুক বো ফিন ৯১
গম্ভীর ক পিটারসেন বো ফিন ৫৮
কোহলি এলবিডব্লিউ সোয়ান ৩৫
রায়না ক পিটারসেন বো ব্রেসনান ০
ধোনি ন:আ: ৩৫
জাডেজা ন:আ: ২৬
অতিরিক্ত ১৭
মোট ৪৯.২ ওভারে ৩০০-৫
পতন: ৭৯, ১৯০, ২১২, ২১৭, ২৩৫
বোলিং: ফিন ১০-০-৪৪-২, ব্রেসনান ৭.২-০-৬২-২, ডার্নবাখ ১০-০-৬৯-০,
পটেল ১০-০-৫০-০, সোয়ান ১০-০-৫৯-১, বোপারা ২-০-৮-০। |
|
|
|
|
|
|
|