রুপোলি শস্যে বিপর্যয় এ বঙ্গে, নজরদার কোথায়
-পারের রসনাপূর্তির রসদ জোগাচ্ছে ও-পার!
ভরা মরসুমেও পশ্চিমবঙ্গে এ বছর ইলিশের হাহাকার। অগত্যা এখানকার বাঙালির পাতে শুধুই বাংলাদেশের ইলিশ। স্থানীয় মাছ নেই বললেই চলে। শুধু বেআইনি ভাবে ধরা দু’শো-আড়াইশো গ্রামের ছোট ইলিশ। তা-ও বাজারে ঢুকেছে অতি সম্প্রতি।
পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে দিঘা-কাকদ্বীপ-নামখানা বা রায়দিঘির মতো মাছ ধরার বড় বড় কেন্দ্রগুলোর কোথাও এ মরসুমে ইলিশ কার্যত ওঠেইনি। রাজ্যের অন্যতম বৃহৎ মৎস্যবন্দরটি দিঘা মোহনায়। মৎস্যজীবীদের সংগঠন ‘ইউনাইটেড ফিশারমেনস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি প্রণব কর জানাচ্ছেন, দিঘা মোহনায় গত বছর ৬ থেকে ৭ হাজার টন ইলিশ উঠেছিল। এ বছর একশো টনও নয়!
ফলত বাংলাদেশের রফতানির উপরেই এ বছর পশ্চিমবঙ্গে ওঠা-নামা করেছে ইলিশের দর। কিন্তু এ বঙ্গে ইলিশের কেন এমন আকাল? অভিজ্ঞ মৎস্যজীবীদের মতে, গঙ্গার মোহনা থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্রেও অজস্র ট্রলার যে ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে ইলিশ থাকার প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। উপরন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেদার ব্যবহার হচ্ছে ৯০ মিলিমিটারের ছোট ফুটোর জাল। তাতে প্রচুর ছোট ইলিশ ধরা পড়ায় দু’দিকেই ক্ষতি ভবিষ্যতে বড় ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমন ইলিশের বংশবৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। অথচ সরকারি নজরদারির শৈথিল্যের সুযোগে নির্বিচারে ছোট ইলিশ শিকার চলছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মৎস্যজীবীদের একাংশ। ব্যারাকপুরের সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআইএফআরআই) অবশ্য মনে করে, এ ক্ষেত্রে ফাঁসের মাপের নিম্নসীমা ৯০ মিলিমিটার করাটাও যথেষ্ট নয়। তাদের বক্তব্য, ইলিশ ধরার জালের ফুটো হওয়া চাই অন্তত ৪ ইঞ্চি বা ১০০ মিলিমিটার। ইনস্টিটিউটের নদী-মৎস্য বিভাগের প্রধান উৎপল ভৌমিকের আক্ষেপ, “গত বছর ৮০ টন ছোট ইলিশ ধরা হয়েছে! না-হলে এ বছর অন্তত ৪০ লক্ষ বড় ইলিশ মিলত। এখন তো ৩০-৪০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বাজারে খয়রা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে!”
ইলিশ নেই কেন
গঙ্গার মোহনায় অত্যাধিক পলি
সমুদ্রে মিষ্টি জলের জোগানে টান
মোহনার ৩০ কিমি পর্যন্ত যথেচ্ছ শিকার
ছোট ফাঁসের জাল বল্গাহীন
ট্রলারের দাপাদাপি
ফলও মিলেছে হাতেনাতে। দিঘা মোহনার মৎস্যজীবীরা বলছেন, দু’-তিন বছর ভাল ইলিশ ওঠার পরে মাঝে এক বছর হয়তো কম ওঠে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। দিঘার অধর দাসের কথায়, “গত চল্লিশ বছর মাছ ধরছি, ইলিশের এমন আকাল দেখিনি।”
প্রণববাবুর দাবি: দিঘা মোহনার সমস্ত ট্রলার বা যন্ত্রচালিত নৌকোয় ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার নিয়ে অ্যাসোসিয়েশনের নজরদারি আছে। কিন্তু নামখানা বা কাকদ্বীপে যথেচ্ছ ছোট ইলিশ ধরা চলছে বলে অভিযোগ।
মোহনায় ও সমুদ্রে ট্রলার নিয়ন্ত্রণেরও আবেদন জানিয়েছে ইউনাইটেড ফিশারমেন্স অ্যাসোসিয়েশন।
প্রণববাবু বলেন, “ট্রলার বা মাছ ধরার যন্ত্রচালিত নৌকোর রেজিস্ট্রেশনে নিয়ন্ত্রণ নেই শুধু পশ্চিমবঙ্গেই। অথচ বাংলাদেশ তো বটেই, ওড়িশা-অন্ধ্রও কবে ট্রলারের রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দিয়েছে। এত ট্রলার সমুদ্রে নামলে ইলিশ কেন, ক’বছরের মধ্যে আর কোনও মাছই পাওয়া যাবে না।” সংগঠনের হিসেবে, শুধু দিঘা মোহনাতেই গত এক বছরে একশোরও বেশি নতুন ট্রলার রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে।
মাছের প্রজনন, ডিম পাড়া এবং পোনা বড় করার সুযোগ দিতে সমুদ্রে ৪৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। এটা কেন্দ্রীয় সরকারি আইন। কিন্তু প্রণববাবুরা চাইছেন, বড় ইলিশ পেতে হলে পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িশাকে সম্মিলিত ভাবে অন্তত ৬০ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখা দরকার।
বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত টেনে তাঁরা বলছেন, “ওখানে যে শুধু গোটা এপ্রিল-মে মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে তা-ই নয়, মাছেদের নির্বিঘ্নে ডিম পাড়ার সুযোগ দিতে বর্ষার শেষাশেষিও অন্তত দু’সপ্তাহ সমুদ্রে ট্রলার নামতে দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ অনেক কড়া। ছোট ইলিশ ধরা তো বটেই, বিক্রির উপরেও সেখানে নজরদারি রয়েছে।”
এই নজরদারির অভাবের সঙ্গে সমুদ্রে মিষ্টি জলের সরবরাহ কমে যাওয়াটাও পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের ফলনে বিপর্যয়ের বড় কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। সিআইএফআরআইয়ের মৎস্য-বিজ্ঞানী উৎপলবাবুর ব্যাখ্যা, এ রাজ্যে গঙ্গা ছাড়া আর কোনও নদী সমুদ্রে গিয়ে মেশেনি। অথচ গঙ্গায় জলের জোগান নানা কারণে হ্রাস পাচ্ছে। মোহনায় পলি জমে স্রোতের বেগ কমিয়ে দিচ্ছে, মার খাচ্ছে গভীরতাও। ফলে মোহনায় জলের নোনাভাব বেড়ে চলেছে। এ দিকে ইলিশ গভীর সমুদ্র থেকে মোহনার তুলনায় মিষ্টি জলে এসে ডিম পাড়ে। ছানাপোনা নিয়ে সেখানে কিছু দিন কাটিয়ে গভীর সমুদ্রে ফিরে যায়।
কিন্তু প্রাকৃতিক কারণ ও মানুষের কার্যকলাপে এ-পারে ইলিশের এই জীবনচক্র ভীষণ ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যেখানে ও-পারে পরিস্থিতিটা অনেক অনুকূল। যেমন, বাংলাদেশে অনেকগুলো নদী সমুদ্রে এসে পড়ায় সেখানকার মোহনায় জলের নোনাভাব কম, ফলে ইলিশ প্রজননও হচ্ছে বেশি হারে। উপরন্তু জাল ও ট্রলার নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশ কয়েক কদম এগিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন এ-পারের মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু এখানকার সমুদ্রে প্রতিকূল পরিবেশের কোনও প্রভাব ওই অঞ্চলে পড়ছে না?
রাজ্য মৎস্য দফতর সূত্রের ব্যাখ্যা, দুই দেশের সমুদ্র-সীমার মাঝে আছে সুন্দরবন। যার লাগোয়া বিস্তীর্ণ সাগরে কোনও দেশের লোকই মাছ ধরে না। এটাই কার্যত পাঁচিলের কাজ করছে। রাজ্যের মৎসমন্ত্রী আবু হেনা বলেন, “কড়াকড়ির সুবাদে বাংলাদেশে ইলিশ বাড়ছে। কিন্তু এখানে কমছে।” আর উৎপলবাবুর কথায়, “মিষ্টি জলে টান ও মোহনা থেকে সমুদ্রের ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে যথেচ্ছ মাছ ধরার ফলেই আজ এ রাজ্যে এই দুর্দশা। আমরা মৎস্যজীবীদের বোঝাচ্ছি। বলছি, কী করতে হবে।”
এবং এখনই তা করা না-গেলে এ-পারে ইলিশমাছ ভবিষ্যতে ছবি আর স্মৃতিতেই টিকে থাকবে বলে আশঙ্কা মৎস্যজীবী ও বিজ্ঞানীদের। সরকার কী ভাবছে?
মৎস্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, “এই সব অনিয়ম বন্ধ করতে প্রয়োজনে আইন আরও কঠোর করব।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.