শ্রীলঙ্কার উপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত। তামিল জঙ্গি গোষ্ঠী এল টি টি ই-কে দমনের নামে দেশের সংখ্যালঘু তামিল জনসাধারণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কৃত যুদ্ধাপরাধের তদন্ত ও বিচারের দাবিতেই এই চাপ। প্রথমে ‘রেড ক্রশ’, তাহার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি এবং সর্বশেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন ও মহাসচিব বান-কি-মুন দাবিটি উত্তরোত্তর জোরের সঙ্গে জানাইয়া আসিয়াছেন। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজাপক্ষের সরকার অভিযোগগুলিকে ‘মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়া পাল্টা প্রচার অভিযান চালাইয়াছে। এমনকী অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের দালালি করার, সন্ত্রাসবাদকে বৈধতা দেওয়ার পাল্টা অভিযোগও আনিয়াছে। রাষ্ট্রপুঞ্জকে বস্তুত অসামরিক তামিল নাগরিকদের গণহত্যা ও গণধর্ষণের বিরুদ্ধে কোনও প্রস্তাব পর্যন্ত গ্রহণ করিতে দেওয়া হয় নাই। শ্রীলঙ্কার ‘বন্ধু রাষ্ট্রগুলি’ এ ব্যাপারে তাহার সহায়ক হইয়াছে। কিন্তু কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রজোট রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো শ্রীলঙ্কা-মিত্রে ভর্তি নয়। তাই সেখানে কলম্বো সমালোচনার মুখে।
আগামী মাসে অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে রাজাপক্ষেকে কাঠগড়ায় তুলিবার তৎপরতা শুরু হইয়া গিয়াছে। অস্ট্রেলিয়া, এবং পরে কানাডা, গেরিলা সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হওয়ার দায়ে রাজাপক্ষে সরকার ও সেনাবাহিনীর তীব্র সমালোচনা করিয়াছে। অভিযুক্ত রাজনীতিক ও সেনা-অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত পর্যন্ত করিতে না-চাওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে নিন্দা ও ধিক্কার উচ্চারিত হইতেছে। দুই দেশই এমনকী শ্রীলঙ্কাকে কমনওয়েল্থ হইতে বহিষ্কার করার এবং ২০১৩ সালে কলম্বোয় অনুষ্ঠেয় শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করার কথাও বলিয়াছে। রাজাপক্ষের ‘ভাবমূর্তি’ অতএব রীতিমত সঙ্কটে। চিন, রাশিয়া বা ইজরায়েলের মতো মিত্ররাও তাঁহাকে এ ক্ষেত্রে রক্ষা করিতে পারিবে না, কেননা কমনওয়েল্থ-এ তাহাদের ঠাঁই নাই। এখানে সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিরই প্রাধান্য। একমাত্র ভরসা ভারত। পাছে কলম্বো পুরোপুরি চিনের কোলে ঢলিয়া পড়ে, তাই শ্রীলঙ্কা-তামিলদের গণহত্যার মানবিক প্রশ্নটির চেয়েও রাজাপক্ষে সরকারের সহিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেই নয়াদিল্লি অগ্রাধিকার দিতে পারে। রাজাপক্ষে অতএব কমনওয়েল্থ-এর মঞ্চেও নির্বান্ধব থাকিতেছেন না।
তথাপি এই মঞ্চ হইতে তাঁহার শাসনপ্রণালীর প্রতি ধিক্কার উচ্চারিত হওয়ার তাৎপর্য আছে। স্লোবোদান মিলোসেভিচকে যদি ‘এথনিক ক্লিনজিং’-এর জন্য ‘দ্য হেগ’-এর আন্তর্জাতিক কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হয়, তবে রাজাপক্ষেই বা অব্যাহতি পাইবেন কেন? তাঁহার সরকার ও তাহাতে একচ্ছত্র ক্ষমতাসীন রাজাপক্ষে পরিবার দ্বীপভূমির সংখ্যালঘু তামিলদের প্রতি একই অনাচারই করিয়াছে। গেরিলা-নির্মূলকরণ অভিযানের অন্তিম পর্বে প্রায় চল্লিশ হাজার অসামরিক তামিল নিহত হইয়াছেন, হাজার-হাজার তামিল রমণী ধর্ষিতা, শিশুরা পঙ্গুমানবাধিকার সংস্থাগুলির অভিযোগ এমনই। সরকারি গণমাধ্যম একতরফা রাজাপক্ষে-বন্দনা গাহিতেছে, বেসরকারি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত, বিশিষ্ট সাংবাদিকরা প্রতিবাদী কিংবা বিবেকবান হইলেই নিহত বা নিখোঁজ, তথ্যের সূত্রের কাছে কাহাকেও পৌঁছাইতে দেওয়া হয় না। তামিলদের পক্ষে একটি শ্বাসরোধকর, অসহায়, অবমানবের অস্তিত্ব কোনও ক্রমে টিকাইয়া রাখাও ক্রমশ দুঃসাধ্য। তাঁহাদের ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্ম-ইতিহাস সব কিছুর উপর দিয়া উগ্র সিংহলি-বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের স্টিম-রোলার চলিতেছে। আর এই স্বৈরাচারকে গণতন্ত্র বলিয়া প্রচার করিতেছেন রাজাপক্ষে ও তাঁহার আন্তর্জাতিক মিত্ররা। অন্তত কমনওয়েল্থ সেই গোয়েবল্সীয় মিথ্যাচারের উন্মোচনে সত্যান্বেষী হউক। |