নগর পুড়িলে দেবালয়ও বাঁচে না। গ্রিসে বিপদ দেখা দিলে ভারতে তাহার কিছুমাত্র আঁচ পড়িবে না, বিশ্বায়নের যুগে কি তাহা হয়? আর, শুধু গ্রিস নহে, গোটা ইউরো অঞ্চল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১১-১২ অর্থবর্ষে সর্বত্রই নাভিশ্বাস উঠিতেছে। ২০০৮ সালের মন্দার ক্ষত সম্পূর্ণ সারে নাই, তাহার পূর্বেই দুনিয়াব্যাপী ফের ‘গেল, গেল’ রব। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া বলিয়াছেন, দুনিয়াব্যাপী এই টালমাটালে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হারও ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। এই অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার আট শতাংশের কাছাকাছি থাকিবে। যদিও, শুধু আন্তর্জাতিক সমস্যার দোহাই দিয়া ভারতের পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা চলে না। কেন, তাহার কারণ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথায় স্পষ্ট। অর্থমন্ত্রী বলিয়াছেন, কঠোর আর্থিক নীতি বৃদ্ধির পক্ষে প্রতিকূল হইতেছে। অর্থমন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুও দিনকয়েক পূর্বে এই কথাটিই বলিয়াছিলেন। অর্থমন্ত্রী অবশ্য একই সঙ্গে বলিয়াছেন, অনেক দেশ যেমন সুদের হার কমাইতে আরম্ভ করিয়াছে, ভারত অন্ধ ভাবে সেই পথে হাঁটিবে না।
অন্ধ অনুসরণ অবশ্যই অনুচিত, কিন্তু কঠোর আর্থিক নীতির পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণে রাখিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত এক বৎসর ক্রমাগত সুদের হার বাড়াইয়া গিয়াছে। মূল্যস্ফীতির সমস্যা লইয়া উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। সেই সমস্যার সমাধানে যত কঠিন কাজই হউক, করিতে হইবে। কিন্তু, সুদের হার বাড়াইলেই কি মূল্যস্ফীতি কমে? অর্থনীতির তত্ত্ব বলিবে, মূল্যস্ফীতি যদি বাজারে টাকার জোগানের আধিক্যের কারণে হয়, তবে সুদের হার বৃদ্ধিই সেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়। কেন মূল্যস্ফীতি ঘটিতেছে, বাস্তবে তাহা নির্ভুল ভাবে বলা কঠিন। কিন্তু, এক বৎসরেরও বেশি সময় কঠোর আর্থিক নীতি বজায় রাখিয়াও যদি মূল্যস্ফীতি না কমে, তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, রোগের কারণ বুঝিতে ভুল হইতেছে। ফলে, চিকিৎসাও ঠিক পথে হইতেছে না। অন্য দিকে, কঠোর আর্থিক নীতি শিল্পক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাজারে ঋণ পাওয়া কঠিন হইলে বিনিয়োগের হার কমে। তাহার ফলে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতে বিভিন্ন বণিকসভা, ব্যাঙ্ক বার বার এই কথাটি বলিয়াছে। আশঙ্কাটিকে অবজ্ঞা করিবার উপায় নাই। অনুমান করা সম্ভব, ব্যাঙ্ক এখনই সুদের হার কমাইবে না। পুনরায় হার না বাড়িলে বাজারে অন্তত এই বার্তাটি পৌঁছাইবে যে সরকার সমস্যাটির কথা ভাবিতেছে। বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস অর্জন করিতে এই বার্তার দাম অনেক।
অবশ্য, দেশের আর্থিক বৃদ্ধি শুধু সুদের হারের উপর নির্ভরশীল নহে। ভারতে দুইটি ঘাটতি বৃদ্ধির হারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলিতেছে। প্রথমটি রাজকোষ ঘাটতি। অর্থমন্ত্রী জানাইয়াছেন, বাজেটে যে ৪.৬ শতাংশ রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হইয়াছিল, তাহাতে সম্ভবত পৌঁছানো যাইবে না। অগস্ট মাসের মধ্যেই ঘাটতির পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ৬৬ শতাংশ হইয়াছিল। তাহার পর সরকার বাজার হইতে বিপুল ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা করিয়াছে। স্বাভাবিক ভাবেই ঘাটতি লক্ষ্যমাত্রার বেশি হইবে। প্রবণতাটি বৃদ্ধির হারের পক্ষে বিপজ্জনক। দ্বিতীয় ঘাটতির নাম শাসনের ঘাটতি। ইউ পি এ সরকার এই ঘাটতির চরম সীমায় পৌঁছাইয়াছে। অর্থমন্ত্রী দেশের বিরোধী দলগুলিকে আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে সরকারের সহিত ঐকমত্যে উপনীত হইতে অনুরোধ করিয়াছেন। সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা যে সরকারি স্তরে অনুভূত হইতেছে, তাহা ভাল কথা। কিন্তু, সেই সংস্কারের লক্ষ্যে পৌঁছাইতে হইলে সরকারকে সুশাসনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী শুনিতেছেন কি? |