ব্যক্তিগত জীবনে দু’জনে বন্ধু ছিলেন। জ্যোতি বসু এবং সির্দ্ধাথশঙ্কর রায়। ঘটনাচক্রে, রাজারহাটের নিউ টাউন জ্যোতিবাবুর নামে করার ক্ষেত্রে বাদ সেধেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে ‘রাজনৈতিক সৌজন্য-অসৌজন্যে’র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই বৃহস্পতিবার বিধানসভায় রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থবাবুর প্রতিকৃতি উদ্বোধনের অনুষ্ঠান উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকল ‘রাজনৈতিক সৌজন্যে’র জন্যই।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিকৃতির আবরণ উন্মোচন করলেন। সেই অনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকলেন রাজ্যের শাসক জোটের মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতাদের সঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান, প্রবোধ সিংহ এবং রাজ্য বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমও। রাজনৈতিক মতাদর্শে যাঁদের অবস্থান সিদ্ধার্থবাবুর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। বস্তুত, সুর্যবাবু আগেই জানিয়েছিলেন, নিউ টাউনের নামকরণে বাধা দিয়ে রাজ্য সরকার ‘রাজনৈতিক অসৌজন্য’ দেখালেও সিদ্ধার্থবাবুর প্রতিকৃতি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘সৌজন্য’ দেখাতে তাঁরা হাজির থাকবেন। তাঁদের ‘আমন্ত্রণ’ জানানোর জন্য সূর্যবাবু বিধানসভা কর্তৃপক্ষকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন। অনুষ্ঠানে আসার জন্য তাঁদেরও ‘ধন্যবাদ’ জানান পরিষদীয়মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
বিধানসভার অলিন্দে এ দিনের অনুষ্ঠানে বিরোধীদের ‘সৌজন্য’ দেখাতে কার্পণ্য করেনি সরকার পক্ষও। মঞ্চে রীতিমতো ‘স্বাগত’ জানিয়ে সূর্যবাবু, হালিমকে আসনে বসানোর ব্যবস্থা করতে দেখা যায় পার্থবাবুকে। সূর্যবাবুদের পাশেই বসেছিলেন পার্থবাবু, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় ও রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী সুব্রত বক্সী। মঞ্চে উঠে সূর্যবাবু ও হালিমকে দেখে হাত জোড় করে ‘নমস্কার’ করেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্বে শাসক-বিরোধী নেতাদের একযোগে প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যায়। |
অনুষ্ঠানের প্রথম বক্তা হালিমের বক্তব্যের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিলে যায় শেষ বক্তা মমতার কথার সুরও। সিদ্ধার্থবাবু, রাজ্যের আরও দুই প্রাক্তন ও প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে টেনে মমতা বলেছেন, “রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু তাঁদের অবদান স্বীকার করার মানসিকতা থাকা উচিত।” হালিম বলেন, “সিদ্ধার্থবাবু আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতের মিল ছিল না। জ্যোতিবাবু, স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে সিদ্ধার্থবাবু ও তাঁর স্ত্রী মায়া রায়ের মতাদর্শের মিল ছিল না। কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল। মত যার যা থাকুক, ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকা উচিত নয়। আমি আশা করব, আগামী দিনে সেই পরিবেশটা ফিরে আসবে।”
সিদ্ধার্থবাবুর মৃত্যু তাঁর কাছে যেমন ‘বিরাট ক্ষতি’ বলে জানিয়েছেন মমতা, তেমনই হালিমও বলেন, “আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুব খারাপ লাগছে।” স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিধানসভায় স্বরাষ্ট্র্র দফতর এবং ওই দফতরেরই কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার বিভাগের বাজেটে বিরোধী দলনেতা হিসাবে সিদ্ধার্থবাবুর বক্তৃতাকে ‘অপূর্ব’ আখ্যা দেন হালিম। বর্তমান স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “পরিষদীয় দল যে সৌজন্য নিয়ে চালাতে হয়, তা সিদ্ধার্থবাবু দেখিয়েছিলেন।” সূর্যবাবুও বলেন, “আমি এখন বিরোধী দলনেতা। সিদ্ধার্থবাবুও বিরোধী দলনেতা ছিলেন। তাঁর থেকে অনেক কিছু শিখেছি।” সিদ্ধার্থবাবুকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে অভিহিত করেন কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরব।
রাজনীতির ‘সৌজন্য-মঞ্চে’ মমতা অবশ্য বলেন, “মানুদা’র (সিদ্ধার্থবাবুর ডাক নাম) বিরুদ্ধে অনেক অপপ্রচার হয়েছে। প্রশাসক হিসাবে তাঁকে অনেক সময়ে কঠোর হতে হয়েছে। কাশীপুরের গণহত্যার জন্য তাঁকে খুনি বলা হয়েছে। উনি দুঃখ পেতেন। মানুষটা যেমন লম্বা ছিলেন, তাঁর মনটাও অনেক বড় ছিল। আমি তাঁকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সমস্ত কাগজপত্র দেখাতেন। মানুষের কাছে সত্যিটা তুলে ধরতে কাশীপুর গণহত্যার বিষয়ে আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।” মমতার ‘দুঃখ’, তাঁর ‘পরিবর্তনের লড়াই’য়ে সিদ্ধার্থবাবু ‘অভিভাবক’ হওয়া সত্ত্বেও নতুন সরকারের ক্ষমতায় আসা ‘মানুদা’র দেখা হয়নি।
আমন্ত্রিত হলেও ‘অসুস্থতা’র জন্য অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি সিদ্ধার্থ-জায়া মায়াদেবী। তবে সিদ্ধার্থবাবুর ভাইপো, ভাইজি-সহ পরিবারের অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। মায়াদেবীর পাঠানো একটি চিঠি স্পিকার অনুষ্ঠানে পড়েন। মমতাকে ‘অভিনন্দন’ জানিয়ে মায়াদেবী লিখেছেন, ‘কমিউনিস্টদের হারানোর জন্য তাঁকে আমি ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে সমস্ত রকম সমর্থন জানাচ্ছি’। সূর্যবাবুরা অবশ্য চিঠি নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। বিরোধী শিবিরের ব্যাখ্যা, ‘সৌজন্যে’র পরিমণ্ডল তাঁরা ভাঙতে চাননি। |