অন্তিম মুহূর্তের আকুতি, আমাকে গুলি কোরো না
মুয়ম্মর গদ্দাফি নিহত! ৪২ বছর শাসনের পরে তাঁর মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে পদাঘাত করছে একদল মানুষ। বেপরোয়া লাথি পড়ছে লিবিয়ার নিহত প্রাক্তন স্বৈরশাসকের মুখে, মাথায়, বুকে।
রাজধানী ত্রিপোলি থেকে উৎখাতের পরে অনুগত বাহিনীর ঘেরাটোপে প্রায় দু’মাস সির্তে শহরে আত্মগোপন করেছিলেন গদ্দাফি। এই শহরেই এক বেদুইন তাঁবুতে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। বৃহস্পতিবার দুপুরে বিদ্রোহী বাহিনী গদ্দাফিকে তাড়া করে সেই সির্তের কেন্দ্রস্থলে ঢুকে পড়ার পরেই সরে পড়তে চান লিবিয়ার ‘লৌহপুরুষ’। সঙ্গে মুষ্টিমেয় কয়েক জন অনুগামী। বেশি দূর এগোনো যায়নি। ন্যাটোর নজরদার বিমানের বোমাবর্ষণে চুরমার হয়ে যায় তাঁর কনভয়। মারা যান কয়েক জন অনুগামীও। দীর্ঘ ৪২টি বছর ত্রিপোলির বাদশাহী প্রাসাদের বিলাসে জীবন কাটানো এই স্বৈরশাসককে শেষ আশ্রয় হিসাবে বেছে নিতে হয় রাস্তার এক জলনিকাশি পাইপের গর্তকে। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সেখানে তাঁকে ঘিরে ফেলার পরে আরব দুনিয়ায় দীর্ঘতম শাসনের রেকর্ড গড়া স্বৈরশাসকের শেষ আকুতি ছিল, “আমাকে গুলি কোরো না তোমরা!” ইতিমধ্যেই তিনি জেনে এসেছেন, বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের দায়িত্বে থাকা প্রিয় পুত্র মুতাস্সিম লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
কিন্তু প্রবল পরাক্রান্ত একনায়কের জীবনের অন্তিম মুহূর্তের জন্য সীমাহীন লাঞ্ছনাই তুলে রেখেছিল নিয়তি। দুনিয়া জুড়ে তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছু পরে প্রকাশ্যে আসে একটি টিভি ফুটেজ। ছবি কাঁপলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, গদ্দাফিকেই টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে সশস্ত্র বিদ্রোহী যোদ্ধারা। স্রেফ গণধোলাইয়ের ঢঙে তারা কেউ গদ্দাফির চুল টানছে, কেউ মারছে মুখে ঘুসি। মৃতপ্রায় স্বৈরশাসকের মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে।
লড়াই শেষ গদ্দাফির। তাঁর মৃতদেহের এই ছবি পাওয়া গিয়েছে একটি ভিডিও থেকে।
এর ঠিক পরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই রয়ে যাচ্ছে সামান্য ধোঁয়াশা। গদ্দাফি কী ভাবে মারা গেলেন, তা নিয়ে উঠে আসছে পরস্পরবিরোধী নানা ব্যাখ্যা। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, গর্তে পড়া গদ্দাফিকে সরাসরি গুলিতে ঝাঁঝরাই করে দিয়েছিল ন্যাটোর অস্ত্রে সজ্জিত বিদ্রোহী সেনারা। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানাকে তোয়াক্কা করেনি তারা। কিন্তু ভিডিওটি পরিষ্কার করে দেয়, গদ্দাফিকে গর্ত থেকে বার করে আনা হয়েছিল। ঘটনাস্থলে সেই সময়ে উপস্থিত এক বিদ্রোহী সেনার দাবি, গর্ত থেকে বেরিয়েও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন গুরুতর আহত গদ্দাফি। বিদ্রোহীরা তাঁকে বেধড়ক মারধর শুরু করে। ওই মারের চোটেই তাঁর প্রাণ বেরিয়ে যায়। কিন্তু পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া একটি প্রায় আবছা ছবিতে দেখা যায়, গদ্দাফির কপালের পাশে বুলেটের ক্ষতের মতো গর্ত। এমনকী বিদ্রোহী সংগঠনগুলির সমন্বয়ে গড়া অন্তর্বর্তী প্রশাসন ‘ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’ (এনটিসি)-এর এক মুখপাত্রও এক চিকিৎসককে উদ্ধৃত করে বলেন, গদ্দাফির মাথায় ও পেটে বুলেটের ক্ষত রয়েছে। শুরু হয় আর এক প্রস্ত জল্পনা। তবে কি মারধরের পরে ঠান্ডা মাথায় গুলি করা হয়েছিল লিবিয়ার চার দশকের শাসককে? যদিও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিব্রিল জানিয়েছিলেন, গদ্দাফি ঠিক কী ভাবে মারা গেলেন, সে সম্পর্কে সবিস্তার তথ্য তাঁদের কাছে নেই। সুস্পষ্ট চিত্র প্রশাসনের হাতে এলে জানানো হবে। সময় গড়িয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ ঘিরে অস্পষ্টতাটা রয়েই গিয়েছে।
একটি সূত্র বলছে, গদ্দাফি নিহত হওয়ার পরে তাঁর দেহ অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি মিসরাতা শহরের একটি মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বেশ খানিকক্ষণ পরে এনটিসি-র আর এক মুখপাত্র আব্দেল হাফেজ ঘোগা এক লাইনের বিবৃতিতে জানান, “আমরা গোটা বিশ্বের কাছে ঘোষণা করছি, বিদ্রোহে গদ্দাফি নিহত হয়েছেন।” অবশ্য সংবাদ চ্যানেলগুলির দৌলতে তার আগেই ‘খবর’ পৌঁছে গিয়েছে দুনিয়ার প্রতিটি কোণে। শুধু তাতে কোনও স্বীকৃতির সরকারি মোহর ছিল না।
৮ মার্চ, ২০১১। ত্রিপোলির
রিক্সোস হোটেলে গদ্দাফি। তখনও
হারাননি লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ।
আসলে এর আগে এনটিসি-র কোনও কর্তা দাবি করেছিলেন, গদ্দাফি আহত, বন্দি। আবার কেউ বলেছিলেন, তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক। মারাও গিয়ে থাকতে পারেন। ওয়াশিংটন জানিয়েছিল, তারা ঘটনার সত্যতা সন্ধানে ব্যস্ত। যে ন্যাটো সরাসরি গদ্দাফি-বিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে, তারাও যেন মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। ঘণ্টা কয়েকের বিভ্রান্তি গোটা দুনিয়ায়। আসলে সেই সময়ে মিসরাতায় চলছিল ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার পালা। গদ্দাফির নিরাবরণ দেহ রাস্তায় ফেলে চলছিল বেপরোয়া লাথালাথি। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল শবদেহ। অনেকে আবার ছবিও তোলেন মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় (সে সব ছবিই পরে প্রকাশ্যে আসে)। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধানমন্ত্রী জিব্রিল ঘোষণা করেন, “লড়াইয়ে মারা গিয়েছেন গদ্দাফি। লিবিয়া মুক্ত।”ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে রাজধানী ত্রিপোলির ‘গ্রিন স্কোয়্যার’-এ মুষ্টিমেয় কয়েকশো মানুষের গদ্দাফি-বিরোধী স্লোগান ছিল বিদ্রোহের অঙ্কুর। ৪২ বছর ধরে কর্নেল গদ্দাফি যে স্বৈরশাসন চালিয়ে গিয়েছেন, লিবিয়ার মানুষ তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে শেষ পর্যন্ত সাফল্য পাবেন, এমন আশা বোধহয় বিদ্রোহী মানুষগুলো ছাড়া আর কেউই করেননি। এই বিদ্রোহকে হেলায় চুরমার করার আত্মবিশ্বাস ছিল গদ্দাফির নিজেরও। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়া যে এমন হবে, তা বোধ হয় তিনি ভাবতে পারেননি। দেশের নাগরিকদের কামান-রাইফেলের নিশানা করার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশাসনে তাঁর অতি অনুগতরাও একে একে ইস্তফা দিয়ে নেমে দাঁড়ালেন বিদ্রোহীদের পাশে। বিশ্বস্ত বাহিনীর মধ্যেও ক্ষোভের পাহাড়, প্রতিবাদের ঘূর্ণিস্রোত। সেনাদের একাংশ স্বজনদের দিকে বন্দুক তুলে ধরার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করে নেমে এল রাস্তায়। তাদের বুকে টেনে নিল বিদ্রোহীরা। একের পরে এক শহরে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আগুন।
শেষের সময়
গদ্দাফির ছেলে মুতাস্সিম ও সইফ অবশ্য বেপরোয়া। তাঁরা তখনও আশা করছেন, বলপ্রয়োগে এই বিদ্রোহকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাহিনী কমছে। একে একে ছেড়ে যাচ্ছেন সেনারা। তাই ঘানা, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, এমনকী বাংলাদেশের ভাড়াটে যোদ্ধাদেরও বাহিনীতে আনলেন স্বৈরশাসক। অন্য দিকে বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র জোগাতে লাগল ন্যাটো। লিবিয়ার উপরে ‘নো ফ্লাই জোন’ তৈরি করে রাজধানী ত্রিপোলি-সহ সরকারি বাহিনীর ঘাঁটিগুলির উপরে ঘনঘন হামলা চালাতে লাগল ন্যাটোর বিমান। লিবিয়া জুড়ে পুরোদস্তুর যুদ্ধ।
অগস্টে রাজধানী ত্রিপোলির দখল নিল বিদ্রোহী যোদ্ধারা। গদ্দাফির প্রাসাদেও ঢুকে পড়ল বিদ্রোহীরা। কিন্তু গদ্দাফি কোথায়? কেউ বলল, তিনি অন্য দেশে পালিয়েছেন, কারও বা ‘পাকা খবর’, মাটির নীচে প্রাসাদ গড়ে দিব্যি রয়েছেন স্বৈরশাসক। কিন্তু একে একে শহরগুলির পতনের পরে গদ্দাফির অনুগত বাহিনী সির্তে শহরে যে ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাতেই বোঝা গিয়েছিল ৬৯ বছরের কর্নেল হয়তো জন্মস্থানেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। অনুগত বাহিনীর প্রতিরোধ চূর্ণ করে এ দিন সেই শহরেও ঢুকে পড়ে বিদ্রোহীরা। তার পরে আর সেখানে থাকার ঝুঁকি নেননি গদ্দাফি। তাড়া খাওয়া বাঘের মতোই দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি।
ন্যাটোর এক সেনাকর্তা সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, দুপুর নাগাদ কয়েকটি গাড়ির একটি কনভয়কে তাঁরা সির্তে ছেড়ে পালাতে দেখে নিশ্চিত হন, সরকারের কোনও মাথাই এই কনভয়ে রয়েছেন। একটি বিমান উড়ে গিয়ে তার উপরে বোমা ফেলে। গাড়িগুলি চুরমার হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কয়েক জন সেনা সেখানে পৌঁছে গিয়ে দেখেন, আহত গদ্দাফি গর্তে লুকিয়ে রয়েছেন।
গদ্দাফির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে মামলা শুরু করেছিল আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করে তারা। কিন্তু মৃত্যু সেই বিচারের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল স্বৈরশাসককে। আবার অনেকে বলছেন, ভালই হল। যুগোস্লাভিয়ার শাসক স্লোবোদান মিলোসেভিচের বিচারের সময়ে আন্তর্জাতিক আদালত যে ভাবে নাকানি চোবানি খেয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি থেকে তারাও রক্ষা পেল।
কিন্তু গদ্দাফির পরে? শান্তি ফিরবে লিবিয়ায়? এই প্রশ্নই এখন সব চেয়ে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিদ্রোহী নেতারা নতুন পতাকা বেছে নিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, বিদ্রোহের পালা সাঙ্গ, এ বার দেশ গঠনের পালা। কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে হাতে এত রাইফেল-বন্দুক, আগের সরকারের অনুগতদের প্রতি এই তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা সেই ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করতে দেবে তো? নাকি আরও এক ইরাক বা আফগানিস্তানের জন্ম দিয়ে গেল গদ্দাফির মৃত্যু?

ছবি: রয়টার্স



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.