 |
কোন পথে |
ক্ষমতার ‘মোহ’ ছেড়ে
নতুন বিরোধী হতে চায় সিপিএম
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
|
সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে অতীতের বহু ভুল স্বীকার করে এ বার মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন আনতে চলেছে সিপিএম।
২০১২ সালের ৪-৯ এপ্রিল সিপিএমের আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের পৃথক মতাদর্শগত দলিলে দলের এক নতুন অভিমুখ পাওয়া যাবে। এই নতুন সিপিএম বিরোধী দল, রাষ্ট্রব্যবস্থা বা শাসক দলের অঙ্গ নয়। আবার তেমনই পঞ্চাশ-ষাট এমনকী সত্তর দশকের বিরোধী কমিউনিস্ট পার্টিও নয়। সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “গোটা দুনিয়ায় নতুন করে বাম রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা এসেছে। কারণ পুঁজিবাদ আবার এক প্রবল সঙ্কটের মুখে। ওয়াল স্ট্রিটে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু ষাটের দশকের বাম-ও তো নেই। সে দিন কোকাকোলা এমনকী কম্পিউটারের বিরুদ্ধেও আমরা আন্দোলন করেছি। আজ তো তা করব না।”
সিপিএম নেতৃত্ব বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে দল এবং রাষ্ট্র (সরকার) যেন এক হয়ে গেছে। রাষ্ট্র (সরকার) গিলে খেয়েছে দলকে। ’৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে দলীয় নেতৃত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সমাজ পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, বহু ক্ষেত্রেই আপস করেছেন মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব। সমাজ পরিবর্তন কোথায়? দলের কিছু নেতা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে দল আর সরকার কার্যত এক হয়ে যাওয়ায় সরকার বা প্রশাসনের ক্ষমতার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল দল। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেনের কথায়, “এত দিন ক্ষমতায় থাকার পর নিজেদের বিরোধী ভাবতেই অনেক সময় লাগবে। শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, প্রবীণদেরও ভাবতে সময় লাগবে।”
১৯৭৮ সালের ২৭-৩১ ডিসেম্বর হাওড়ার সালকিয়ার দলীয় প্লেনামে বহু মতাদর্শগত বিচ্যুতি খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু মতাদর্শগত বিতর্ক প্রশ্নে দলীয় নেতৃত্ব এখনও অনেকটাই গোপনীয়তা বজায় রাখেন। প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা অশোক মিত্রর মতো অনেকেই মনে করছেন যে, শুধু দলের সদস্যরা নন, দলের বাইরে সমর্থকদেরও একটা বড় বৃত্ত রয়েছে। তাঁরাও জানতে চান, এ বার দল কোন অভিমুখে এগোবে। কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনায় দলে এখনও আড়ষ্টতা অনেক।
সিপিএমের দলীয় গঠনতন্ত্রের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, দলের লক্ষ্য সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চিন কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শ মেনে সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের কথা আগে বলত। কিন্তু বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিস্ট পার্টির একচ্ছত্র শাসনে থেকেও এই দুই দেশের কোথাওই সমাজতন্ত্র থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ ঘটেনি। তা ছাড়া, ভারতের যা রাষ্ট্রচরিত্র, তাতে একটি বা দু’টি রাজ্যে ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র তো দূর, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে কী করে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। তা ছাড়া সেই পরিস্থিতিও তো তৈরি হয়নি। উল্টে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দল আরও দুর্বল হয়েছে। মানুষের সমর্থনও কমেছে।
সালকিয়া প্লেনামে দলে বৃদ্ধির সমস্যার কথাও বলা হয়েছিল। অর্থাৎ ’৭৮ সালেই সিপিএম নেতারা বুঝেছিলেন, সদস্য সংখ্যা বাড়লেও দলের কর্মীদের গুণগত মান বাড়ছে না। বিপ্লবী সচেতনতাও বাড়ছে না। এ বার পার্টির দলিল তৈরির সময় বলা হচ্ছে, কী ভাবে দল এই শ্রেণি-সচেতনতা বাড়াবে? সালকিয়া প্লেনামেই বলা হয়েছিল যে, দলের গণভিত্তি শ্রমিক এবং কৃষক হলেও নেতৃত্ব শুধু নয়, সদস্যদের
মধ্যেও মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিকতা বাড়ছে। আজ এত বছর পরও সে প্রবণতা কমেনি। সালকিয়া প্লেনামেই আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ
পুঁজি ও শিল্পপতিরা আছে। এখানে দলের রাজনৈতিক
লাইন কী হবে, সে প্রশ্নও উঠেছিল। এই সব অনেক বিষয়ই আজও প্রাসঙ্গিক।
লেনিনের মৃত্যুর পরে ক্ষমতায় বসে স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে জাতীয়তাবাদী সংশোধনবাদ এনেছিলেন। কিন্তু বুখারিন স্তালিনের ভাবনার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি অবশ্য দলের প্লেনামে পরাস্ত হন। পরবর্তী কালে সিপিএম স্তালিনের পথকেই সমর্থন করে। কিন্তু ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এসেই ধীরে ধীরে স্তালিনের পথের সমালোচনা শুরু করেন। পরবর্তী কালে সেই সুর ক্রমশ চড়া হয়। ব্রেজনভ থেকে আন্দ্রোপভ হয়ে গর্বাচভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির হালচালই বদলে যায়। কিন্তু তার পরেও টিকিয়ে রাখা যায়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা তার কমিউনিস্ট পার্টিকে। চিন অবশ্য বাজার-অর্থনীতির বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এবং তার
বাস্তবসম্মত প্রয়োগ ঘটিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে।
পার্টি কংগ্রেসের আগে মতাদর্শগত দলিলে তাঁর মতামত জানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, ভবিষ্যতের চলার পথ ঠিক হবে নিছক সে দিনের স্তালিনীয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নয়। বরং আজকের আন্তর্জাতিক আর্থ-সামাজিক সংকটে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-নিরুপম সেন-বিমান বসু-সূর্যকান্ত মিশ্র তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্ব মনে করছেন, সিপিএমকে এ দেশের, এ রাজ্যের প্রেক্ষিতে এগোতে হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের অন্ধ অনুকরণের চেয়ে সেটা বেশি জরুরি। সম্প্রতি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মহা অধিবেশনে হু জিনতাও নিজেও বারবার বলেছেন, দলকে চিনের নিজস্ব প্রয়োজন ও সমস্যার প্রেক্ষিতেই এগোতে হবে। সেই পথেই এগোনোর ভাবনা এ বার সিপিএমেও।
সাড়ে তিন দশক একটানা ক্ষমতায় থাকার দিন এখন অতীত। ২০১২ সালে নতুন এক বিরোধী দলের ভূমিকায় এগোতে হবে সিপিএমকে। কিন্তু দলের নেতারা বুঝতে পারছেন, এটা বলা যত সহজ, বাস্তবে তাকে কর্মসূচির ভিত্তিতে রূপ দেওয়ার কাজটা তত সহজ নয়। সেই কঠিন পথের খোঁজই এ বার করবে সিপিএম। |