এক দিকে মঙ্গলকোটের লাখুরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক ডাক্তার। বদলির নির্দেশ এসে গেলেও তাঁকে ছাড়তে চান না গ্রামের মানুষ। কারণ, রোগীর গায়ে পচে যাওয়া জায়গাতেও হাত দিয়ে চিকিৎসা করেন তিনি। প্রায়ই ওষুধ কিনে দেন দুঃস্থ রোগীদের। অন্য দিকে, মন্তেশ্বরের ধান্যখেড়ুর গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। যিনি নিজেই বলছেন, “গ্রামের দিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করলে কেরিয়ারে বিশেষ কয়েকটা সুবিধা মেলে। তাই এই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পড়ে রয়েছি।”
মন্তেশ্বরের ধান্যখেড়ুর গ্রামে প্রাথমিক এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে স্থানীয় মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। তাই আন্দোলনে নেমেছেন স্থানীয় প্রায় ২০টি গ্রামের মানুষ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গণস্বাক্ষর করা একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে ২০ শয্যার ইন্ডোর রেখে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে রাজ্য সরকারকে।
পাঁচ কিলোমিটার দূরে বনপুর থেকে শ্বশুর মেসেরউদ্দিনের চিকিৎসা করাতে ধান্যখেড়ুর গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এনেছেন হাসিনা বেগম। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে বমি করে চলেছেন মেসেরউদ্দিন। কিন্তু টানা তিন ঘণ্টা ধরে সেখানে পড়ে থাকা মেসেরউদ্দিনকে স্যালাইন পর্যন্ত দিতে পারেননি স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদেরই এক জন, ফার্মাসিস্ট চন্দন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “বার বার ডাক্তারবাবুকে ফোন করেছি। উনি বলছেন, ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারবেন না। তাই মেসেরউদ্দিনের পুত্রবধূকে বলেছি, ওঁকে অন্যত্র নিয়ে যেতে।” অভিযোগ, পরে চিকিৎসক এসে রোগীকে দেখেই বলে দেন, এখানে ইন্ডোর নেই। ওঁকে মেমারি বা বর্ধমানে নিয়ে যান। |
মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকে ধান্যখেড়ুর গ্রামের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ছবি: উদিত সিংহ। |
স্থানীয় মানুষজনের দাবি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বয়স প্রায় ৬৫। মাঝে ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির পরিষেবা বলতে কার্যত কিছুই ছিল না। কিন্তু স্থানীয় এক বধূ জ্ঞানদাসুন্দরীদেবী এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য জায়গা দেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাড়িও তৈরি করিয়ে দেন তাঁর ছেলেরা। পরে গত দু’বছরে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছিলেন। ছয় শয্যার একটি অন্তর্বিভাগ (ইন্ডোর) গড়ে উঠেছিল। ছিল প্রসবের ব্যবস্থাও। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুরনো দুই চিকিৎসক বদলি হয়ে যাওয়ায় ইন্ডোর বন্ধ হয়ে যায়। এমনকী আউটডোর পরিষেবাও এখন ঠিক মতো মেলে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো গণস্বাক্ষর করা চিঠিতে এই অভিযোগই জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলের করণিক আপালচন্দ্র দাসের কথায়, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইন্ডোর একটা সময় ভালই চলত। কিন্তু দুই চিকিৎসককে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই হাল।” ধান্যখেড়ুর গ্রামের বাসিন্দা প্রকাশ কর্মকার দীর্ঘ দিন ধরেই ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এই দশার জন্য তিনি সরাসরি এখানকার এক মাত্র চিকিৎসক অরিন্দম কোনারকে দায়ী করেছেন। আর এক বাসিন্দা তুষারকান্তি রায়ের অভিযোগ, “অরিন্দম কোনারের একটি চেম্বার রয়েছে বর্ধমানে খোসবাগানে। তিনি সেখানেই বেশির ভাগ সময় থাকেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী দেখতে আসতে বললে, উনি মুখের উপরে জবাব দিয়ে দেন, ‘চেম্বার ছেড়ে যেতে পারব না।’’
তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সময়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে উপস্থিত না থাকার অভিযোগ মেনে নিয়ে চিকিৎসক পরিষ্কার বলেছেন, “রোজ বর্ধমান থেকে গাড়ি নিয়ে এখানে আসতে হয়। এখানে ইন্ডোর চালু করা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। বদলির চেষ্টা করছি। কারণ এই গ্রামে থেকে তো প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালানো যায় না।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফার্মাসিস্ট থেকে নার্স, প্রত্যেকেই কবুল করেছেন, একদা এখানে ইন্ডোর চালু ছিল। কিন্ত এখন তা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের নিদের্শেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দুই নার্স অনামিকা মণ্ডল ও পম্পা মালিক বলেছেন, “এক সময় আমরা এখানে ইন্ডোরে নাইট ডিউটি করেছি। এখন ডাক্তারবাবু বলার পরেই তা বন্ধ রাখা হয়েছে।”
তবে চিকিৎসক অরিন্দমবাবুর দাবি, “এখানে কোনও দিনই ইন্ডোর চালু ছিল না। হয়তো জরুরি ভিত্তিতে কাউকে রাতে ভর্তি করানো হত। ইন্ডোর চালু ছিল বলে যাঁরা দাবি করছেন, তাঁরা জেনেবুঝে মিথ্যে বলছেন।” স্বাস্থ্যকর্মীরা অবশ্য আরও জানিয়েছেন, কোয়ার্টার ভাঙাচোরা থাকায় তাঁদের পক্ষে রাতে থাকা সম্ভব হয় না।
বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তন্ময় মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আরও দু’জন নার্স দরকার। তার ব্যবস্থা করতে পারলেই ফের ইন্ডোর চালু হবে ধান্যখেড়ুতে।” কিন্তু মাত্র এক জন চিকিৎসক দিয়ে কী করে চলবে ওই ইন্ডোর? তন্ময়বাবু বলেন, “ওখানে তো দু’জন চিকিৎসক রয়েছেন বলেই জানি। এক জনকে দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালানো হচ্ছে, এ কথা তো আমি জানি না! খোঁজ নিচ্ছি।” |