পশ্চিমবঙ্গের তীব্র আর্থিক সঙ্কট কাটানোর উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে এক নৈশভোজের ফাঁকে তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, “আর্থিক সঙ্কট নিয়ে শীঘ্রই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চাই আমি। এই পরিস্থিতির জন্য মমতা দায়ী নয়। এটি ইতিহাসের বোঝা।”
জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে আগামী ২২ তারিখ দিল্লি আসছেন মমতা। সে দিনই তিনি মমতার সঙ্গে কথা বলবেন বলে প্রধানমন্ত্রী জানান। একই সঙ্গে এ-ও স্পষ্ট করে দেন যে, “পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন কোনও কাজ কেন্দ্র করবে না।”
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি রাজ্যের অর্থসচিবকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়ে এ ব্যাপারে সবিস্তার জানতে চান তিনি। রাজ্য কোষাগারের হাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন নারায়ণন। |
আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও মাস-মাইনে এবং পেনশন মেটানো সরকারের বড় মাথাব্যথা। যে কারণে গত শুক্রবার বাজার থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আশা করেছিলেন, এ বছর রাজস্ব আদায় ৩০ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু চলতি অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে বাস্তবে আদায় বেড়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। ফলে অনেক অঙ্কই উল্টে গিয়েছে। আর্থিক সঙ্কট কাটাতে কেন্দ্রের তরফে বেশ কিছু সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের বক্তব্য, সেই সব সাহায্যের প্রতিটিই প্রকল্পকেন্দ্রিক। তাতে দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্বাস্থ্য ফিরলেও স্বল্পমেয়াদি কোনও সুবিধা হচ্ছে না। কারণ, এখন রাজ্যের মূল সমস্যা কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, মহার্ঘ ভাতা দেওয়া এবং কেন্দ্রের দেওয়া ঋণের সুদ মেটানো। কিন্তু প্রকল্পের জন্য পাওয়া টাকায় কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যায় না। দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রীকে সেই কথাটাই বুঝিয়ে বলবেন মমতা।
রাজ্যকে কী দিয়েছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক? ২৭০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ধার দেওয়া হয়েছে। তাতে রাজ্যের উপর সুদের বোঝাও আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, এই টাকা শোধ করলে রাজ্য আরও টাকা ধার করতে পারবে। এ ছাড়া পিছিয়ে পড়া জেলাগুলিতে ১১টি প্রকল্পের জন্য ৮৭৫০ কোটি টাকার ‘সুপারিশ’ করেছেন প্রণববাবু। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘এই টাকা দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশের প্রস্তাব করছি’। এই ভাষা নিয়েও ধন্ধে রাজ্য সরকার।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যখন গোটা অর্থবর্ষের জন্য পরিকল্পনা হয়েছিল, তখন মোট ১৭,৮২৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছিল কেন্দ্র। এর মধ্যে গোড়াতেই ৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছিল রাজ্য। ফলে নতুন সরকারের জন্য পড়েছিল ১১,৮০০ কোটি টাকা।
অতীতে কেন্দ্র বারংবার বলা সত্ত্বেও ‘আর্থিক শৃঙ্খলা ও বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাশ করায়নি রাজ্য। ফলে তারা যত খুশি ধার নিতে পারত। বাম জমানার একেবারে শেষের দিকে ওই আইন পাশ করানো হয়। যে কারণে এখন অমিত মিত্র চাইলেও ইচ্ছামতো ধার নিতে পারছেন না।
অমিত মিত্র কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে বলেছেন, রাজ্যের ঘাড়ে যে দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণ চাপিয়ে বামেরা বিদায় নিয়েছে, তার জেরে প্রতি মাসে প্রায় ২০০০ কোটি টাকা সুদ গুণতে হচ্ছে সরকারকে। কর্মচারীদের বেতন ও পেনশনের জন্য দিতে হয় মাসে ২৭০০ কোটি টাকা। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মোট ১৬ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বকেয়া। সে জন্য লাগবে ৪৮০০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক দায়ভার বহন করা বর্তমান পরিস্থিতিতে কার্যত অসম্ভব। কেন্দ্রীয় করের যে অংশ রাজ্য পায়, তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সুতরাং অতিরিক্ত স্বল্প মেয়াদি সাহায্য ছাড়া গতি নেই।
কিন্তু কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক অন্যান্য রাজ্যের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা কোনও সাহায্য করতে ইচ্ছুক নয়। তাদের যুক্তি, একটি রাজ্যকে সাহায্য করলে অন্য রাজ্য বায়না করবে। কিন্তু বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্র নানা ভাবে সাহায্য করতে পারে।
আর ঠিক এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তাঁর বক্তব্য, বামফ্রন্টের আমলে দীর্ঘদিন ধরেই আর্থিক পরিস্থিতি বেহাল হলেও কেন্দ্র কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। উদাহরণ হিসেবে মমতার ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হচ্ছে, বামফ্রন্ট আমলে গত এপ্রিল মাসে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট চরমে ওঠে। টাকার অভাবে বেতন-পেনশন বন্ধের জোগাড় হয়েছিল। বিলের টাকা মেটানো যাচ্ছিল না। বেতন-পেনশন ও বিল মেটাতে তখন ১৭০০ কোটি টাকা দরকার ছিল রাজ্যের। এই অবস্থায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত দিল্লি এসে দু’মাসের সংস্থান হিসেবে ৩,৪০০ কোটি টাকার সাহায্য নিয়ে যান।
মমতার বক্তব্য, তখন এ রকম ‘অ্যাডহক’ নীতি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক রাজ্য সরকারকে সাহায্য করে গিয়েছে কেন? ওভারড্রাফ্ট সংস্কৃতিতে রাজ্য সরকার নিমজ্জিত হলেও এত বছর ধরে কেন্দ্র কেন তাদের আর্থিক শৃঙ্খলা শেখায়নি? আর সেই কেন্দ্রই কেন আজ তাঁকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক উপদেশ দিচ্ছে? এ বার দিল্লি এসে এই সব প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন মমতা। আর রাজ্যের বিপদ কাটাতে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
তবে আশু সঙ্কট কাটাতে অর্থ মন্ত্রকের উপর নির্ভরশীল
না থেকে বাজার থেকে সরাসরি অর্থ সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। কিন্তু তাঁকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। কারণ, ঋণ নেওয়া মানেই সুদের বোঝা ঘাড়ে চাপা। সেই বিষচক্র কাটিয়ে রাজ্যকে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে গেলে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সেই কাজ অবশ্যই করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাজার থেকে টাকা তোলা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। |