|
|
|
|
|
|
তুমি কী চাও... |
ডুব দাও নিজের পছন্দের গভীরে |
জয়েন্ট এন্ট্রান্সের বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো লেখাপড়া করতে চাও? খুব ভাল। তা হলে তোমার
জন্য কয়েকটি প্রাথমিক পরামর্শ রইল। আপাতত কেবল বিজ্ঞান বিষয়ে। জানালেন পথিক গুহ |
তাহলে তুমি ঠিক করে ফেলেছ যে, আই আই টি বা অন্য এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসবে না। বেশ, বেশ। পাঁচ-সাত বছর আগে হলে তোমার এই সিদ্ধান্তে বাড়িতে প্রায় কান্নাকাটি পড়ে যেত। বাবা-মা, দাদা-দিদিরা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসত, তোমার হলটা কী? হঠাৎ এমন ‘কুবুদ্ধি’ তোমার মাথায় এল কেন? পড়াশোনায় তুমি ভাল, স্কুলের রেজাল্টও বেশ ঝকঝকে। এমন ছেলে বা মেয়ে যারা, তাদের কেরিয়ার তো পাথরে খোদাই করে লেখাই থাকে। ক্লাস টুয়েলভ-এর পরীক্ষার পাশাপাশি হয়তো ওই পরীক্ষার চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়ে অন্য কয়েকটি এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতি। মোটা টাকা খরচ করে কোচিং ক্লাস। মক টেস্টের পর মক টেস্ট। মনের কোণে স্বপ্ন একটাই। আই আই টি বা ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট-এ খুব ওপরে র্যাঙ্ক। ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ডাক্তারি কোর্সে ভর্তি। ব্যস। এমন মসৃণ কেরিয়ার প্ল্যান ছেড়ে যারা অন্য কিছু ভাবে, তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গুরুজনদের উদ্বেগের শেষ থাকত না। তাঁদের মুখে শোনা যেত একটাই শোকবার্তা: নিজের পায়ে কুড়ুল কেউ মারে?
আসলে শুধু ভবিষ্যৎ চিন্তা নয়, ক্লাস টুয়েলভ-এর পর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসতে চাইত না যারা, তেমন বেয়াড়া ছেলেমেয়ের বাবা-মায়েরা পড়তেন আরও এক ফ্যাসাদে। পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে তাঁদের লজ্জায় মাথা হেঁট! পরীক্ষায় রেজাল্ট যাদের বাঁধিয়ে রাখার মতো, কেবল তারাই ভর্তি হতে পারে কানপুর আই আই টি কিংবা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এ তো একেবারে ধ্রুব সত্য। তা-ই যদি হয়, তা হলে যারা বসছে না এন্ট্রান্স পরীক্ষায়, তারা যে মোটেই হিরের টুকরো নয়, তা কি আর বলে দিতে হয়? তা হলে, স্কুলে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের কথা বড় গলায় পাঁচ জনকে বলেছেন যে বাবা-মা, তাঁদের নয়নের মণিটি ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারিতে না গেলে, পাঁচ জন যে ধরেই নেবে অন্য কিছু। ভাববে, বাবা-মা বড় গলায় এত দিন যা-ই বলুক, ছেলে বা মেয়ে আসলে মোটেই তত ব্রিলিয়ান্ট নয়। এ হেন মানহানি মানা যায়?
তোমরা ভাগ্যবান। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টেছে। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসতে চায় না যে ছেলে বা মেয়ে, তার কেরিয়ারের কথা ভেবে রাতের ঘুম চলে যায় না বাবা-মায়ের। পাড়াপ্রতিবেশীও আর তার দিকে কৃপার দৃষ্টিতে তাকায় না। অন্তত আগের মতো নয়। সমাজ ঠেকে শিখেছে। আই টি ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি মানেই যে স্টার্টিং স্যালারি ষাট হাজার টাকা নয়, মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বেরুনো মাত্রই যে পাঁচশো টাকা ফি-র ডাক্তার হওয়া যায় না, সে-সব সত্যের মুখোমুখি হয়ে সমাজের ভাবধারায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। ঘটেছে কেরিয়ার ভাবনায় স্বাদবদল। গবেষণা কিংবা অধ্যাপনা এখন, কিছুটা হলেও, গ্ল্যামারাস। গ্ল্যামার লক্ষ্মীর আশীর্বাদ বিনে অসম্ভব। গত পাঁচ বছরে ভারতে অধ্যাপক, বিজ্ঞানীদের বেতন যা দাঁড়িয়েছে, তা মোটেই নাক সিঁটকোনোর মতো নয়। গবেষণায় অনুদানের ব্যাপারেও এ দেশের সরকার এখন বেশ উদার। তার একটা সুফল ফলেছে বাবা-মা, পাড়াপ্রতিবেশীর চিন্তাভাবনাতেও। |
|
তাই বলছিলাম, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার যদি হতে না চাও, তা হলে এখন আর তোমায় দেখে সবাই অবজ্ঞা করবে না। বরং, দারুণ না হলেও, একটু-আধটু সমীহ করবে। ভাববে, কে জানে বাবা, তুমিই হয়তো আগামী দিনের অশোক সেন কিংবা কিরণ মজুমদার শ। অশোক সেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় এখন জগৎজোড়া নাম। আর কিরণ এম শ গবেষিকা থেকে বায়োটেক কোম্পানির মালিক। অন্যদের মনে হবে, তুমিও বনে যেতে পারো সে রকম কেউ। তবে সেটাও খুব বড় কথা নয়। অন্যে তোমার সম্পর্কে কী ভাবল, তা তুমি যত কম ভাববে ততই ভাল। তুমি বরং ভাব তোমার লক্ষ্য নিয়ে। গবেষণাকে কেরিয়ার বানানোর যে পরিকল্পনা তুমি করেছ, সে স্বপ্ন কী ভাবে সফল হতে পারে, তা ভাব ভাল করে। বানিয়ে ফেল একটা তালিকা। কোন পথে এগোবে, তার রূপরেখা। দু’একটা পরামর্শ রইল তোমার জন্য।
|
সবার আগে |
খুব ইচ্ছে তোমার, তুমি হবে নাম-করা বিজ্ঞানী। স্বপ্ন দেখা খুব ভাল, কিন্তু মনে রেখো, স্বপ্নটাকে বাস্তব করে তোলা সহজ কাজ নয়। একটা জিনিস খুব দরকার। ভাল রেজাল্ট। নামী কলেজে পছন্দের বিষয়ে অনার্স কোর্সে ভর্তি হতে চাও তুমি, অ্যাকাডেমিক দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সেটা সাধারণত বেশ জরুরি। যথাসময়ে ভর্তি হতে গিয়ে দেখবে, তোমার চাওয়ার কোনও মূল্যই থাকবে না, যদি তোমার নম্বর যথেষ্ট বেশি না হয়। কারণ, তোমার মতো ইচ্ছে আরও অনেকের। তারাও চায় ওই কলেজে ওই বিষয়ে অনার্স পড়তে। তো, কলেজ কর্তৃপক্ষ কাদের বেছে নেবেন? অবশ্যই যাদের নম্বর বেশি। অনেক ভাল কলেজেই অ্যাডমিশন টেস্টের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেই টেস্টে বসার যোগ্যতাও আবার ঠিক হয় নম্বরের ভিত্তিতে। এখানে আবার আর এক বাধা। ধরো, তুমি চাইছ ফিজিক্স অনার্স। তো তোমার শুধু পদার্থবিজ্ঞানে ৮০-৮৫ শতাংশ নম্বর পেলেই চলবে না। ভর্তি হতে গিয়ে দেখবে, কলেজ বলছে, তোমার মোট নম্বর হতে হবে ৭৫ শতাংশ, ফিজিক্স ও ম্যাথমেটিক্স-এ ৮০ শতাংশ। ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? তুমি পড়তে চাও ফিজিক্স নিয়ে, কিন্তু ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স-এ বেশি নম্বর পেলেই রেহাই নেই। কেমিস্ট্রি, বাংলা এবং ইংরেজিতেও টুয়েলভ-এর পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেতে হবে। না-হলে গ্র্যান্ড টোটাল-এ বেশি হবে কী করে?
অনেকেই গোড়া থেকে এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয় না। ভাবে পড়ব তো সায়েন্স, ইংরেজি বাংলায় ভাল না হলেও চলবে, ও সব বিষয় তো আর্টস-এর। এমন ভুল ধারণার মাসুল যাতে না দিতে হয়, সে দিকে খেয়াল রেখো। পরীক্ষায় মোট নম্বর বাড়ানোর জন্যই সব ক’টা পাঠ্য বিষয়ে বেশি নম্বর চাই।
মোদ্দা কথা, তোমার ইচ্ছেটাকে সার্থক করতে হলে চাই যোগ্যতা। পরের ব্যাপার পরে, শুরুতে যোগ্যতা ঠিক হবে টুয়েলভ-এর পরীক্ষার নম্বর দিয়ে। সেই নম্বর যাতে বেশি থাকে, প্রথমে তার চেষ্টা।
|
কোন বিষয়? |
মৌলিক বিষয় নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তোমার। কলা বিভাগে সেগুলো হল সাহিত্য, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, দর্শন ইত্যাদি। আর বিজ্ঞানের কথা যদি ধরো, তা হলে সেগুলো মূলত পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, গণিত এবং অর্থনীতি। এ লেখা শুধু বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে। তাই সেগুলির প্রসঙ্গে দু-চার কথা। পাঠ্য বিষয় একাধিক হলেও, তার মধ্যে একটিকে তোমায় বাছতে হবে। আর এই নির্বাচনের কাজটাও তোমার প্রস্তুতির একটা অঙ্গ।
কোন বিষয়টি হবে তোমার কেরিয়ার চয়েস? অবশ্যই যেটি পড়তে তোমার সবচেয়ে ভাল লাগে। অনেক সময় এমন হয় যে, রসায়ন বিষয়টা কারও দারুণ ভাল লাগে। কিন্তু, পরীক্ষায় কোনও বিভ্রাটের দরুন ক্লাস টুয়েলভ-এর পরীক্ষায় ও বিষয়ে তার নম্বর তেমন বেশি হল না। বেশি নম্বর সে পেল পদার্থবিদ্যায়। নম্বর যা, তাতে নামী কলেজে সে রসায়নে অনার্স পাবে না। অনার্স পাবে পদার্থবিদ্যায়। তখন সে কী করবে? কলেজ নামী, সেখানে ছাত্র হলে পাঁচ জনের কাছে বড় গলায় বলা যায় এই কারণে ওখানে ভর্তি হবে? অনেকেই সে পথে হাঁটে বটে, তবে সেটা সচরাচর ঠিক পথ নয়। সাধারণ ভাবে বলা যায়, অনার্স পড়া উচিত সেই বিষয়ে, যা তোমার সবচেয়ে প্রিয়। কলেজ ততটা নামী না হলেও।
কোনটা তোমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়, তা বুঝবে কী করে? একটা ক্লু নিশ্চয়ই সেই বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর। যদি সব বিষয়ের মধ্যে তুমি সবচেয়ে বেশি নম্বর পাও কেমিস্ট্রিতে, তা হলে ধরে নেওয়া যায় ওটা তোমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। তবে, এটাই একমাত্র ক্লু নয়। পরীক্ষায় নম্বরের পিছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। বিস্তারিত ব্যাখ্যার অবকাশ নেই, একটা উদাহরণ দিই। মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে একশোয় একশো পায় অনেকে। কিন্তু, সেই নম্বরটা দিয়ে কি প্রমাণ হয় যে, তাদের সবারই সবচেয়ে প্রিয় বিষয় গণিত? বা তারা সবাই ওই বিষয়ে ভীষণ পটু? না, তা প্রমাণ হয় না। হয় না, কারণ মাধ্যমিকে অঙ্কের প্রশ্নপত্র যে ভাবে তৈরি হয়, তার উত্তর দেখে বোঝা কঠিন, পরীক্ষার্থী বিষয়টায় কতটা পটু। বা সে গণিত কতখানি ভালবাসে। |
|
তা হলে, তুমি কী ভাবে বুঝবে কোন বিষয়টা তোমার সবচেয়ে প্রিয়? প্রশ্নটার উত্তর অন্য ভাবে দেওয়ার চেষ্টা করি। পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়গুলোয় আলোচনা যা-ই করা হোক, আমাদের বোঝা দরকার এক একটা বিষয়ের নির্যাস বা মূল কথা। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, সত্যিকারের শিল্প বা বিজ্ঞানের পিছনে প্রেরণা জোগায় রহস্য। রহস্যে যে মানুষ আকৃষ্ট হয় না, সে তো নিভে-যাওয়া মোমবাতি। খাঁটি কথা। কলা বা বিজ্ঞান, যে কোনও বিষয়ই কিন্তু এক-একটা রহস্যের কাহিনি। যেমন সাহিত্য যদি হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের, কিংবা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির প্রেমের রহস্য, তো ইতিহাস হল ক্ষমতার উত্থানপতনের রহস্য।
বিজ্ঞানের বিষয়গুলিও তাই। বিবিধ রহস্য-কাহিনি। শত কোটি প্রশ্নের উত্তর। ফিজিক্স? সে তো গাছের আপেলের মাটিতে পড়ার, সূর্যের চার দিকে পৃথিবীর ঘোরার রহস্য উদ্ঘাটন। পরমাণুর গভীরে কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের প্রান্তে কী কী আছে, তাদের খোঁজ। কেমিস্ট্রি হল সোনার সঙ্গে লোহার, কিংবা কয়লার সঙ্গে হিরের, ফারাক ব্যাখ্যা। বা তেল-নুন-ঘি-র মাহাত্ম্যচর্চা। বায়োলজি? সে তো প্রকাণ্ড এক মিস্ট্রি। ভেবে দেখো, যদি তুমি উপাদানেরবিচার করো, তা হলে কিন্তু কোনও ফারাক নেই এক খণ্ড পাথর আর এক গোছা দুব্বো ঘাসে। তবু, অন্য দিকে কত ফারাক ও-দুটো জিনিসে। মাটি জল পেলেও পাথরখণ্ড এক তিল বাড়বে না। আর ঘাস? সে বাড়বে হু-হু করে। পাথর জড়। ঘাস জীব। প্রাণের রহস্য ব্যাখ্যা বায়োলজির কাজ। ইকনমিক্স তো একেবারে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার গল্প। পুজোর দিনে বাজারে আনাজপাতির দাম আগুন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৌড়েছেন মার্কেটে। তাতে কি সব্জির দাম কমতে পারে? সরকারি হুকুমে কি বাজার দর নিয়ন্ত্রিত হয়? সোনার দাম হঠাৎ ফের ঊর্ধ্বমুখী কেন? অর্থনীতি না পড়লে এ সব রহস্যের সমাধান মেলে না। আর ম্যাথ? সে তো এক আজব সাবজেক্ট। দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, গণিতে আমরা যে কী নিয়ে কথাবার্তা বলি, তা আমরা নিজেরাই জানি না। খাঁটি কথা। ভাবো একবার এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ফর্মুলাটার কথা। ‘এ’ জিনিসটা কী? ‘বি’ বা কী বস্তু? কিচ্ছু জানি না আমরা। না জানায় কিচ্ছু এসে-যায় না। কারণ, আমরা এটা জানি যে, এ এবং বি যা খুশি তাই হলেও, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার কিন্তু এ স্কোয়ার, বি স্কোয়ার এবং এ এবং বি-র গুণফলের দ্বিগুণ এই তিনটে জিনিসের সমষ্টির সমান হবে। একাধিক অজানা জিনিস নিয়ে কাজ কারবার। তবু, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা কেমন সাতপাকে বাঁধা! এ ম্যাজিক ছাড়া আর কী?
প্রিয় বিষয় বাছতে বসে নিজেকে প্রশ্ন করো ও-সব রহস্যের মধ্যে কোনটা তোমাকে সবচেয়ে বেশি টানছে। কোন রহস্যের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে তোমার মগজাস্ত্র নিজেকে শান দিতে চায়। যদিও এখন উচ্চতর গবেষণায় ভেঙে যাচ্ছে বিষয়ে-বিষয়ে প্রাচীর, যার চমৎকার উদাহরণ ইকনমিক্স আর ফিজিক্স মিশে গিয়ে ‘ইকনোফিজিক্স’, তবু শিক্ষাক্রমের গোড়ায় তোমাকে জোর দিতেই হবে কোনও একটা বিষয়ে। সুতরাং, পছন্দের বিষয় নির্বাচিত হলে তুমি নিজেকে বিজ্ঞানের বিশেষ একটা বিভাগের সোলজার হিসেবে ভাবতে পারবে। হও না তুমি পদাতিক সৈন্য, তাতে কী? র্যাংকে উন্নতি তো ভবিষ্যতের ব্যাপার।
|
ডুবুরি |
কোন বিষয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করবে, তা তো ঠিক হল। এ বার তোমার কাজ কী? ডুবুরি বনে যাওয়া। হ্যাঁ, এ বার ডুব দাও তোমার পছন্দের বিষয়টির গভীরে। ডুব দাও, দিয়ে অতলে হারিয়ে যাও। পাঠ্য বই তো ও-বিষয়ে একটা-দুটো। তুমি জোগাড় করে পড়ো আরও চার-পাঁচটা। জানি, এমন পরামর্শে ভুরু কোঁচকাবে, বলবে, প্রাইভেট টিউশন, কোচিং-এর পর সময় পাও না পাঠ্য বইটাই ভাল করে পড়ার, তো বাড়তি বই পড়বে কখন? উত্তরে বলি, তোমার দশা যদি তেমনই হয়, যদি এক-একটা চ্যাপ্টার অনেকগুলো বই ঘেঁটে দেখার সময় না পাও, তা হলে, আর যা-ই করো, ভবিষ্যতে গবেষণাকে কেরিয়ার হিসেবে ভেবো না।
বেশি বই পড়লে নির্দিষ্ট বিষয়ে তোমার দক্ষতা ও জ্ঞান, দুটোই বাড়বে। এটা জরুরি শুধু পণ্ডিত হওয়ার জন্যই নয়। জানো নিশ্চয়ই যে এখন ভারতে এক সঙ্গে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রির কম্বাইন্ড কোর্স চালু হয়েছে নানা জায়গায়। আই আই টি-গুলো তো ছিলই, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের বেশ কিছু নামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ সব কোর্সে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয় এন্ট্রান্স টেস্টের মাধ্যমে। ওই টেস্টগুলোয় যাচাই করা হয় নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের জ্ঞানের গভীরতা। যে গবেষণা করতে চায়, সে নির্দিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী না হলে তা করবে কী করে? সুতরাং, বাছাই করা ছেলেমেয়েদেরই চাই। যে ডুব দেবে বিষয়ের যত বেশি গভীরে, সে হবে তত উঁচু দরের গবেষক।
|
প্রেম |
ভাল লাগার কথা অনেক হল। এ বার প্রেম। টেক্সট বুক টেক্সট বুকেরই মতো। তা সে একটা হোক বা পাঁচটা। পাঠ্য বই অনেকগুলো পড়ে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান বাড়তে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে আর এক ধরনের পড়াশুনো। ভাল গবেষক হতে সেই পাঠ ভীষণ উপকারী। তুমি যে বিষয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চাও, তার ইতিহাসটা একটু-আধটু জানার চেষ্টা করো। ইতিহাস মানে তার বিবর্তনের কাহিনি। বিজ্ঞানের এক-একটা শাখা গড়ে উঠেছে কমপক্ষে হাজার-দেড় হাজার বছর ধরে। গড়ে উঠেছে নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে। কাহিনি হিসেবে সেই বিবর্তনগুলো ভীষণ, ভী-ষ-ণ মজার। পড়ো যদি সেই গল্পগুলো, তা হলে মজে যাবে বলে দিলাম। আর, পাবে একটা প্রেক্ষিত। মানে, আজ তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, তার ঠিকানা।
গল্পগুলো পড়তে পারো দু’ভাবে। শুধু বিবর্তনের বর্ণনা হিসেবে, অথবা সেই বিবর্তনের যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের জীবনকাহিনি হিসেবে। সুখের কথা, বিজ্ঞানের সব বিষয়ে এমন দু’ধরনের বই ইংরেজি ভাষায় লেখা হয়েছে অসংখ্য। এত যে, তাদের কথা বলতে গেলে হাজার হাজার শব্দ লিখতে হবে। এখানে তার সুযোগ নেই। তাই বিষয় অনুযায়ী দু-চারটে বইয়ের কথা বলি।
পদার্থবিদ্যা: পড়তে পারো আলবার্ট আইনস্টাইন এবং লিওপোল্ড ইনফেল্ড-এর লেখা ‘দ্য ইভলিউশন অব ফিজিক্স’। বিজ্ঞান কেন যে এক অন্তহীন গোয়েন্দা কাহিনি, তা ব্যাখ্যা করেছেন ওঁরা। মহা রসিক বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান-এর আত্মজীবনী ‘সিয়োরলি ইউ আর জোকিং, মিস্টার ফাইনম্যান’-এ পাবে এক জন নোবেলজয়ী গবেষকের খোলামেলা স্বীকারোক্তি। বুঝবে গবেষণার জগৎটা হতে পারে কত মজার। হাইনজ আর পাগেল-এর ‘দি কসমিক কোড’ অণু-পরমাণু থেকে মহাবিশ্ব পর্যন্ত অনেক কিছুর অনবদ্য ব্যাখ্যা।
রসায়ন: চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও লেখক অলিভার স্যাক্স তাঁর শৈশবের বর্ণনা ‘আংকল টাংস্টেন’ গ্রন্থে। আত্মজীবনীর স্টাইলে লেখা এ বইয়ের আসল উপজীব্য কেমিস্ট্রির সঙ্গে প্রেম। সদ্য বেরিয়েছে দু’খানি বই। স্যাম কিন-এর লেখা ‘দ্য ডিসঅ্যাপিয়ারিং স্পুন’ এবং হিউ-অ্যালডারসি উইলিয়ামস-এর লেখা ‘দ্য পিরিয়ডিক টেলস’। কেমিস্ট্রি যে অণু-পরমাণুর রাসায়নিক বিক্রিয়া বই অন্য কিছু নয়, তা চমৎকার বুঝিয়েছেন দুই লেখক।
জীববিজ্ঞান: বিষয় এক, বই তিন, জেমস ওয়াটসন-এর ‘দ্য ডাবল হিলিক্স’, ফ্রানসিস ক্রিক-এর ‘হোয়াট ম্যাড পারসুট’ এবং হোরেস ফ্রিল্যান্ড জাডসন-এর ‘দ্য এইট্থ ডে অব ক্রিয়েশন’। তিন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা একটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। বিষয়? ডি এন এ-র গঠন আবিষ্কার। পড়লে বুঝবে গবেষণা মানে কেমন রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতা।
অর্থনীতি: নোবেলজয়ী গ্যারি বেকার রচিত ‘দ্য ইকনমিক্স অব লাইফ’ বা টিম হারফোর্ড-এর লেখা ‘দি আন্ডারকভার ইকনমিস্ট’ পড়লে বুঝবে অর্থনীতি বিষয়টা কী ভাবে আমাদের জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে। এ ছাড়া পড়তে পারো স্টিভেন লেভিট
ও স্টিফেন ডাবনার-এর ‘ফ্রিকনমিক্স’।
গণিত: এক-এক বিষয়ের চার্ম এক-এক রকম। গণিতের বেলায় সেটা কী রকম, তা টের পাওয়ার শ্রেষ্ঠ বই বোধ হয় গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি-রচিত ‘আ ম্যাথমেটিসিয়ান’স অ্যাপলজি’। শ্রীনিবাস রামানুজন-এর জীবনী ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিট’ লিখেছেন রবার্ট ক্যানিগেল। গণিতজ্ঞ পল এরডিশ’কে নিয়ে ‘দ্য ম্যান হু লাভড ওনলি নাম্বার্স’ লিখেছেন পল হফম্যান। দু’টিই অনবদ্য রচনা।
পুজোর মরসুম এখন। গিফ্ট পাওয়ার পালা। দেওয়ালির আগে বাবার কাছে এ বার একটা বই চেয়ে ওঁকে সারপ্রাইজ দাও না!
কি জানি, কী হয়
ও সব বই পড়ে কী লাভ? উত্তরে একটা গল্প বলি। গল্প নয়, সত্যি। ১৯৯৫ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি-র অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ওয়াইলস গণিতের একটা ধাঁধার উত্তর দিয়ে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। সংখ্যার সে ধাঁধা শুনলে মনে হবে সহজ। কী রকম? (৩২+৪২= ৫২)। স্কোয়ার বা বর্গের বেলা এ রকম সম্পর্কের তিনটে সংখ্যা (৩,৪,৫) পাওয়া গেল। পাওয়ার ২-এর বদলে আর কোনও সংখ্যা হলে কি ও-রকম তিনটে করে সংখ্যা মিলবে? সামান্য এই প্রশ্নের উত্তর সাড়ে তিনশো বছরে কোনও গণিতজ্ঞ দিতে পারেননি। অবশেষে পারলেন ওয়াইলস।
এই সাফল্যের পিছনে কিন্তু এক আকস্মিক ঘটনা। কী? ওয়াইলস-এর বয়েস যখন দশ বছর, তখন পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনা একটি বইতে ওই ধাঁধার কথা প্রথম জেনেছিলেন তিনি। আর জেনেই ঠিক করে ফেলেছিলেন তাঁর জীবনের স্বপ্ন। সল্ভ করতেই হবে ওই প্রবলেম।
আমরা গন্ধ পাচ্ছি আর একটি ধাঁধার। আচ্ছা, শৈশবে ওয়াইলস যদি ওই বইটি না পড়তেন, তা হলে কি...?
|
কত রহস্যই তো জানা বাকি |
দ্বাদশ
শ্রেণির পরীক্ষার পর আমার ইচ্ছে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করা ও ভবিষ্যতে এই বিষয়েই গবেষণা করা। বিজ্ঞানের অনেক কিছুই এখনও আমাদের কাছে অগোচর। পেশাদারি কোর্স করে পরে মোটা মাইনের চাকরি করার মধ্যে সেই আনন্দ পাওয়া যায় কি, যেটা বিজ্ঞানের কোনও অজানা জিনিসকে উদ্ঘাটন করার মধ্যে আছে?
আমার বিজ্ঞানের প্রতি এই ভালবাসার পেছনে খুব বড় অবদান রয়েছে আমার জেঠুর। উনি সিটি কলেজে বটানির প্রফেসর। ছোটবেলা থেকেই উনি আমাকে নানা ধরনের গাছ, পাখি সম্বন্ধে গল্প করতেন, সুযোগ থাকলে দেখাতেও নিয়ে যেতেন। মনে পড়ে, অনেক সময়ে আমি ওঁর বহু এক্সকারশনে গিয়েছি। বহু বার সায়েন্স সিটি, বি আই টি এম মিউজিয়াম-এও বেড়াতে গিয়েছি জেঠুর সঙ্গে। আর তার জন্যেই বোধ হয় পরিবেশ, জীবজন্তু, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো নানা বিষয়েই ধীরে ধীরে আমার আগ্রহ জেগেছে। বাড়িতে এমনিতে রসায়নের ছোটখাটো পরীক্ষানিরীক্ষা হামেশাই করতাম। টিভিতে অ্যানিম্যাক্স চ্যানেলে ‘ফুটমেটাল অ্যালকেমিস্ট’ বলে এক সময়ে একটা শো হত। বিজ্ঞান
সংক্রান্ত নানা ধরনের অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সব কৌশল দেখাত। প্রতিটা এপিসোড আমি গোগ্রাসে গিলতাম। ফলে আমার বিজ্ঞান কৌতূহলের পেছনে টিভি-রও কিছুটা অবদান আছে। ইচ্ছে আছে কোনও ভাল কলেজে বিষয়টি নিয়ে আগে গ্র্যাজুয়েশন করি। একটা বিষয়ের তো নানা দিক থাকে। তখনই বেছে নেব আমাকে কোন ‘দিক’টা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করছে। সেই মতো পরিকল্পনা করে নেব উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য। |
দীপ্তার্ক হাইত,
দ্বাদশ শ্রেণি, সল্ট লেক স্কুল
|
দীপ্তার্ক ২০১০ সালে টোকিয়োয় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াডে রৌপ্য পদক, ২০১০ সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াডে স্বর্ণ পদক, ২০১১ সালে আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াডে স্বর্ণ পদক, ২০১১ সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বায়োলজি অলিম্পিয়াডে র সব ক’টিতেই স্বর্ণ পদক পেয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য নানা পুরস্কার পেয়েছে সে। |
|
|
|
|
|
|