আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে! প্রায় এক মাস আগে নিউ ইয়র্কে যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তার আঁচ ক্রমেই গ্রাস করছে বিশ্বকে। ওয়াল স্ট্রিট বিক্ষোভের অনুকরণে আর্থিক বৈষম্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে বিশ্বের ৮০টি দেশের প্রায় সাড়ে ৯০০ শহর জুড়ে। আমেরিকা ছাড়া ইউরোপ এমনকী এশিয়ার বেশ কিছু দেশও রবিবার সাক্ষী থাকল এমনই সব প্রতিবাদ কমর্সূচির।
আঁতুড় ঘর নিউ ইয়র্কে রবিবার বিক্ষোভ আন্দোলন এক ভিন্ন মাত্রা পেল। হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারী আজ মিছিল করে টাইমস স্কোয়্যারে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। এর জেরে আজ শহরের ব্যস্ততম রাস্তা ম্যানহাটন স্ট্রিটে কিছু ক্ষণের জন্য যান চলাচল ব্যাহত হয়। নিউ ইয়র্ক থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৮৮ জনকে। এর মধ্যে ৪৫ জনকে ধরা হয়েছে টাইমস স্কোয়্যার থেকে। পুলিশ জানিয়েছে, আজ মধ্যরাত থেকে টাইমস স্কোয়্যারে কার্ফু জারি করা হবে।
কী বলছেন বিক্ষোভকারীরা?
নিউ ইয়র্কের এক ছাত্র নাথানিয়েল ব্রাউনের গলায় ক্ষোভ ধরা পড়ল। বললেন, “আমার মতো অজস্র তরুণ-তরুণী তাঁদের পরবর্তী জীবন শুরু করতে চলেছেন মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। অথচ বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা কিন্তু এরই মধ্যে ঠিকই ফুলে-ফেঁপে উঠছে। মুনাফা বাড়াচ্ছে।”
শুধু নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটনই নয়, শিকাগো, মিনিয়াপোলিস, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং পিটসবার্গের মতো শহরেও আজ বিক্ষোভের আঁচ লেগেছে। শিকাগো থেকে ধরা হয়েছে ১৭৫ জনকে। লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রায় ৫ হাজার ও পিটসবার্গে প্রায় ২ হাজার লোক আজ মিছিল করেন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবরও মিলেছে।
তবে, প্রথমে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও ক্রমেই তা ভয়াবহ আকার নিয়েছে রোমে। কাল রাতে সেখানে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের একটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বাড়িটির ছাদ ভেঙে পড়ে। |
আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে তাঁদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঐতিহ্যপূর্ণ কলোসিয়ামের কাছে সংঘর্ষ খণ্ডযুদ্ধের চেহারা নেয়। কালো মুখোশে মুখ ঢাকা বিক্ষোভকারীরা সারা রোম জুড়ে আজ কার্যত তাণ্ডব চালান। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের দরজায় পাথর ছুড়ে, এটিএম মেশিন ভাঙচুর করেন তাঁরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে জল কামান ও কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুড়তে হয়। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, এতে ৪০ জন পুলিশ অফিসার-সহ আহত ৭০। প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি এই আন্দোলনকে ‘অত্যন্ত দুশ্চিন্তার ইঙ্গিতবাহী’ বলে বর্ণনা করেছেন। রোমের মেয়র গিয়ানি অ্যালেমানো এর জন্য অবশ্য দুষেছেন, ‘এক দল উচ্ছৃঙ্খল তরুণকে, যারা গোটা ইউরোপকে অশান্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে।’
ইতালি ছাড়া পর্তুগালের লিসবন এবং ওপর্তো শহরে আজ প্রায় ২০ হাজার মানুষের মিছিল হয়েছে। আন্দোলনের আঁচ থেকে রেহাই পাইনি গ্রিস-ও। রাজধানী আথেন্সে প্রায় হাজার দু’য়েক মানুষ মিছিল করেছেন। লন্ডনেও দেখা গিয়েছে একই ছবি। সেখানকার স্টক এক্সচেঞ্জ দখলের উদ্দেশে প্রায় হাজার খানেক মানুষ মিছিল করেন। যদিও স্টক এক্সচেঞ্জ পৌঁছনোর আগেই তাঁদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এর পর তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫০ জন সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের কাছে তাঁবু খাটিয়ে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন।
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, তাইওয়ানের তাইপেই, ফিলিপিন্সের ম্যানিলা বা জাপানের টোকিও সব শহরেরই এক ছবি। হাতে পোস্টার। মুখে স্লোগান। সকলেই চান বর্তমান অবস্থার বদল হোক। অসাম্য দূর হোক। ব্যাঙ্ক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘অতি মুনাফালোভী’ কাজ কর্মের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ নথিবদ্ধ করতে সকলে এককাট্টা হয়ে পথে নেমেছেন। মাস খানেক আগে নিউ ইয়র্কে যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তার অনুকরণেই নিজেদের বিক্ষোভ তুলে ধরছেন।
বস্তুত, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে আর্থিক বৈষম্যের প্রতিবাদে নিউ ইয়র্কে শুরু হয় গণ বিক্ষোভ। ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে গোটা আমেরিকায়। আন্দোলনকারীরা মার্কিন অর্থনীতির কেন্দ্র ওয়াল স্ট্রিট দখল করতে অভিযানের ডাক দেন। তাঁদেরপ্রতিবাদের মূল বক্তব্যই হল, গুটিকয়েক ধনকুবেরের কাছে দেশের মোট অর্থের অধিকাংশই কুক্ষিগত রয়েছে। এই অসম বণ্টনের ফলে অসাম্য বাড়ছে। সমস্যার সূত্রপাত এখান থেকেই। শুধু তাই নয়, তাঁদের আরও অভিযোগ, এর জেরে দেশের শিক্ষানীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। |