|
|
|
|
|
|
|
বিপুল নিকট |
সমরেশ মজুমদার |
দুটো গ্লাসে টলটল করছে নেশা, বলছে, আকণ্ঠ গ্রহণ করো আমাকে। দীর্ঘকায় মানুষটি যদিও দাঁড়িয়ে কিন্তু তাঁর দু’চোখে সাহারার তৃষ্ণা। কয়েক পলক পরে তাঁর ঠোঁটে হাসি ফুটল। বললেন, ‘আর!’
অজয় খুব অবাক গলায় বলল, ‘ও রকম আওয়াজ করলেন কেন?’
পায়চারির ভঙ্গিতে খানিকটা ঘুরে এসে বললেন, ‘দ্বিতীয় পাত্রটি তোমার, খবরদার প্রথম পাত্রটিতে আঙুল ছোঁয়াবে না, ওটা আমি গ্রহণ করেছি। তোলো, হাঁ করে দেখছ কী?’
সম্মোহিতের মতো অজয় দ্বিতীয় পাত্রটি তুলে ঈষৎ চুমুক দিল। আজ হচ্ছেটা কী! অনেকক্ষণ পেট খালি থাকলে বায়ু জন্মায়, সেই বায়ুর প্রকোপে কি এমন উল্টোপাল্টা দৃশ্য দেখতে হয়? তখনই মানুষটি দ্বিতীয় বার তৃপ্তির আওয়াজ করলেন, ‘আঃ!’
অজয় মাথা বাড়ল, ‘গ্লাসে চুমুক না দিয়ে ও রকম আওয়াজ কেন করছেন? আমাকে ঢালতে বললেন অথচ নষ্ট করছেন। হুইস্কির দাম কী অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে তার খবর রাখেন?’ ‘মুর্খ! কথাটা দেখছি কানে যায়নি! ঘ্রাণেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। পুরো খাওয়ার যখন উপায় নেই তখন পন্ডিতদের মতো অর্ধেকেই সন্তুষ্ট না হয়ে উপায় কী! আর শোনো, দাম নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।’ বিড়বিড় করলেন তিনি, ‘আমি কি ডরাই ভাই ভিখিরি রাঘবে?’
এ বার উত্তেজিত হয়ে অনেকটা পান করে অজয় বলল, ‘আপনাকে আমি।’
থামিয়ে দিলেন তিনি, ‘এতক্ষণে চৈতন্য পেলে বাবা! যাক গে, আজ তোমার সঙ্গে ওই পণ্ডিতের দেখা হয়েছিল। অথচ সে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কী জ্ঞান দিয়ে গেল সে?’ ‘ও, আপনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা বলছেন? উনি জ্ঞান দেবেন কেন? আমার প্রশংসা করছিলেন।’ অজয় বলল, ‘আপনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। বসুন না!’
মাথা দোলালেন মধুসূদন, ‘যদি জানত তুমি ওই ঘরে বসে প্রত্যহ পান কর তা হলে তার দর্শন পেতে না। এই দ্যাখো, যখন বেঁচে ছিল তখন যে টাকা চেয়েছে তাকেই সাহায্য করেছে। স্বীকার করছি আমাকেও বাঁচিয়ে রেখেছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল আমি চাল ডাল দুধ না কিনে ওর টাকায় পানীয় কিনে খাচ্ছি। যখন তখন টাকা ধার চাইছি। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে এড়াতে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াল। আরে আর যাদের সাহায্য করেছে তাদের আমার মতো লেখার ক্ষমতা ছিল কি? সেই যে পালিয়ে বেড়ানো শুরু করেছিল তা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। যাক গে! তা এই যে মেয়েটিকে ঘরে এনে তুললে, এটাও নিশ্চয়ই তার পরামর্শে?’ ‘হ্যাঁ, মানে--!’ |
|
‘বোঝ! এখন কী করবে? এই মেয়ের ইতিবৃত্ত তোমার জানা নেই! ভাল বংশের না খারাপ পাড়ার মেয়ে তা কি তুমি জানো?’
‘আজ্ঞে, জানার সুযোগ পাইনি।’
‘তবে! এই মেয়ে যদি কাল পাড়ার মানুষদের ডেকে কেঁদে বলে তুমি ওর বেইজ্জত করেছ তখন তোমার কী হবে? বিয়ে করতে পারবে?’
‘সে কী!’
‘তখন সবাই জোর করে তোমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে। ওই বামনে বুড়োর পরামর্শ শুনলে তো এই পরিণতি হবেই।’
‘কিন্তু এই বেচারা বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় যে ভাবে পড়েছিল, না তুললে মরেই যেত!’
‘বাহবা। তা হলে জোব চার্নক যা করেছিল তাই বুক ফুলিয়ে কর। নিজেই বিয়ে করে ওকে সারা জীবনের জন্যে বাঁচিয়ে রাখ। মারিয়াকে যেমন জোব চার্নক রেখেছিলেন।’
এই সময় খাটের ওপর থেকে থেকে অস্ফুট আওয়াজ ভেসে এল। অজয় তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল অঞ্জনা ধীরে ধীরে পাশ ফিরছে। সে নীচের গ্লাস দুটোর দিকে তাকাল। তার পর মনে হল, তার নিজের ঘরে সে যা ইচ্ছে করতে পারে। রোজকার রুটিন কেন এই মেয়েটিকে দেখে পাল্টাবে।
সামনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল অজয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন এসেছিলেন তেমনই মিলিয়ে গিয়েছেন। মানুষটির ছবি দেখেছিল সে। জীবনীও পড়েছিল পাঠ্যবইতে। ওঁর লেখা কোনও বই তার পড়া হয়নি। আজ সামনে পেয়েও তাই ওঁর বই নিয়ে কোনও কথা বলতে পারেনি সে। কিন্তু বিদ্যাসাগর মশাই ওঁকে এড়াতে এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এই খবরটা কেমন অভিনব লাগছে। সে পড়েছিল, বিদ্যাসাগর মশাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই সময় অঞ্জনা বিছানায় উঠে বসল। বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরল কিছুটা সময়। তার পর তাকাল, ‘আমি কোথায়?’
অজয় মাথা নাড়ল। বলল, ‘এখন কিছু বললে আপনি কি মনে রাখতে পারবেন?’
অঞ্জনা তাকাল। বোঝাই যাচ্ছিল সে বিভ্রান্ত।
‘আপনাকে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে গাড়িতে তুলে আমি ফেঁসে গিয়েছি। রাস্তার কোনও জায়গায় নামিয়ে দিলে পাবলিক প্যাঁদাত। হাসপাতালে নিয়ে গেলে পুলিশ ধরত। বিদ্যাসাগর মশাই যেচে পরামর্শ দিলেন বাড়িতে নিয়ে আসতে। আনার পর আপনি মড়ার মতো ঘুমালেন। বৃষ্টি এখনও থামেনি। এত রাত্রে কোনও গাড়ি বা বাস পাবেন না। কী করবেন?’
অঞ্জনা কেঁদে ফেলল।
‘এই দেখুন, কেঁদেটেদে কোনও লাভ নেই। ভাগ্যিস বৃষ্টি হচ্ছে নইলে এত রাত্রে আমার ঘরে মেয়ের গলায় কান্না কেন জানতে পাবলিক ভিড় করে আসত। আমার রান্না হয়ে গেছে। ডিমের ঝোল, ভাত। লাস্ট কখন খেয়েছেন?’
অঞ্জনা কান্না থামাল কিন্তু জবাব দিল না।
‘আমি খাব আর আপনি অভুক্ত থাকবেন এটা হতে পারে না। যান, মুখ ধুয়ে আসুন। আমি খাবার দিচ্ছি।’
অঞ্জনা তবু নড়ছে না দেখে অজয় রেগে গেল। বেশ জোরে ধমক দিল সে, ‘খান। নামুন খাট থেকে। নামুন!’
এ বার অঞ্জনা পুতুলের মতো নেমে এল। চলে গেল মুখ ধুতে।
দ্বিতীয় গ্লাসের বাকিটা গলায় ঢেলে দিল অজয়। প্রথম গ্লাসটা ভর্তি রয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের আত্মা ওটার ঘ্রাণ পান করেছে। আত্মার এঁটো খাওয়া কি উচিত হবে? ইচ্ছের বিরুদ্ধে জানলার পাল্লা খুলে গ্লাসের পানীয় বাইরে ফেলে দেওয়ার সময় বৃষ্টির জলে হাত ভিজে গেল। খুব আফসোস হচ্ছিল অজয়ের। ভদ্রলোক বিদ্যাসাগরের পয়সায় পান করত, এখন দাম দিয়ে কিনতে হলে মজা মাথায় উঠত।
দুটো থালায় খাবার সাজিয়ে তার খেয়াল হল, ঘরে একটাই আসন আছে। দ্বিতীয় মানুষের জন্য আসন রাখার প্রয়োজন হয়নি এত দিন। কিন্তু অতিথি বলে কথা। অঞ্জনার জন্য আসনটি খানিকটা দূরে পেতে থালাটা সামনে রাখতেই সে এল।
‘বসুন। মেঝেতে বসে খেতে হবে।’
অঞ্জনা বসল।
‘রান্না ভাল হওয়ার কথা নয়। যতটা পারবেন খেয়ে নিন।’
‘আমার-- আমার খেতে ইচ্ছে করছে না!’ করুণ গলায় বলল অঞ্জনা।
‘অনেকেরই অনেক কিছু ইচ্ছে করে না। এই যে আপনাকে এই ঘরে এনেছি তা কি ইচ্ছে করে? পুলিশের ভয়ে আর গ্যাস খেয়ে!’
‘গ্যাস?’
‘বললাম না, বিদ্যাসাগর মশাই এখমন গ্যাস দিলেন, খেয়ে নিন।
‘বিদ্যাসাগর? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর?’
নামটা দেখছি জানা আছে। হ্যাঁ, তিনিই।’
এ বার আচমকা হেসে ফেলল অঞ্জনা।
‘হাসলেন কেন?’
‘না। খাচ্ছি, আমি খাচ্ছি।’
খেতে খেতে অঞ্জনা যে তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে তা টের পেল অজয়। সে কোনও কথা না বলে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। থালা গ্লাস ধুয়ে আনার পর দেখল অঞ্জনা নিজের থালা গ্লাস ধুতে যাচ্ছে।
অঞ্জনা ফিরে এলে অজয় বলল, ‘এ বার শুয়ে পড়ুন। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেই দেখবেন ভোর হয়ে যাবে। কিন্তু ভোরেই বেরিয়ে যাবেন। এ পাড়ার লোকজন একটু বেলা করে ওঠে। কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না আপনাকে।’
‘আপনি?’
‘সরি, আমি ওখানে শুতে পারব না।’ ‘কী করবেন?’ ‘জেগে থাকব’।
অজয় হতাশ গলায় বলল, ‘আপনি কি এখনও এই ঘরে আছেন?’
কেউ কোনও সাড়া দিল না। অঞ্জনা আরও অবাক হয়ে অজয়ের মুখের দিকে তাকাল। অজয় তখন ঊর্ধ্বমুখী। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?’ ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম শুনেছেন?’ অজয় তাকাল। ‘যিনি মেঘনাদবধ কাব্য লিখেছিলেন?’ ‘পড়েছেন?’ ‘না।’ ‘বাঁচা গেল। আসলে দু’জনে একই নৌকায় ভাসছি। একটু আগে ভদ্রলোক এখানে এসে প্রচুর জ্ঞান দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছেন। আমার কথা তিনি শুনছেন কিনা জানি না, শুনলেও আমার কিছু করার নেই। বলেই অজয় চেঁচাল, ‘জোব চার্নকের আমল বহু বছর আগে চলে গেছে স্যার। এখন কেউ মারিয়া হতে রাজি নয়। এ মেয়ে কাপড়ের পুটুলি নয়, যে যা ইচ্ছে তাই করানো যাবে।’
অঞ্জনা খাটের প্রান্তে বসল, ‘আপনার কি শরীর খারাপ হয়েছে? কী ভাট বকছেন? তখন বললেন বিদ্যাসাগর এমন গ্যাস দিয়েছেন, এখন মাইকেল মধুসূদনের সঙ্গে কথা বলছেন! আমার খুব ভয় করছে।’ ‘ভয়? কেন? আমাকে অ্যাবনর্মাল লাগছে?’
নর্মাল লোক তো এই সব বলে না। এঁরা কত কাল আগে মরে গেছেন।’ ‘মরে যাওয়া মানেই কি সব ফিনিশ হয়ে যাওয়া? আমি যখন ট্যাক্সি নিয়ে কলেজ স্কোয়ারের সামনে দিয়ে যাই তখন মূর্তিটাকে দেখতে পাই আর ভাবি, ভাগ্যিস উনি বর্ণপরিচয় লিখেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা আমার কাছে বেঁচে ওঠেন। যাকগে, আপনি বসে থাকুন, আমি ঘুমাচ্ছি। সারা দিন খেটেছি, খুব টায়ার্ড। অজয় মেঝেতে এক ধারের বিছানা করে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করেই সে হেসে ফেলল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বললেন, জোব চার্নকের মতো ওকে বিয়ে করে ফেলতে। প্রস্তাবটা এখন দিলে হয়তো এই মাঝরাত্তিরেই জল ভেঙে বেরিয়ে যাবে। সে কালে যা চলত, এখন তা চলে না।
ঘুম ভাঙতে দেরি হল। ভাঙার পর চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মনে পড়ল গাড়িটা বাড়ির সামনে ঠিকঠাক আছে তো? তড়াক ররে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দেখল, সেটা ভেজানো। ছিটকিনি খোলা। তখনই অঞ্জনার কথা মনে পড়ায় সে খাটের দিকে তাকিয়ে দেখল চাদরটা টানটান পাতা। বাথরুমে গিয়ে দেখল, সেখানেও অঞ্জনা নেই। যা বাবা! সে চলে যাবে বলেছিল, কিন্তু যাওয়ার আগে বলে যাওয়ার ভদ্রতাটাও দেখাতে পারল না।
অজয় বাইরে বেরিয়ে দেখল, গাড়িটা আস্ত আছে। লক ভাঙেনি কেউ। চাকাও খুলে নিয়ে যায়নি। আঃ। কী আরাম। সে ঘরে ফিরে মালিককে জিজ্ঞাসা করল, ‘গাড়ি এখন গ্যারেজে নিয়ে যাবে না সন্ধের পর গেলেই চলবে!’
মালিক খিঁচিয়ে উঠল, ‘নিয়ে আসবে মানে? সমস্ত হাঁটুর উপর জল হয়ে আছে। কোথায় থাকো তুমি যে জানো না, আকাশের ডায়াবেটিস হয়েছে!’
হাতমুখ ধুয়ে চায়ের জল বসিয়ে দিল অজয়। আজ কেলো হবে। কলকাতার অনেক রাস্তায় যদি জল জমে থাকে, তা হলে খুব ভুগতে হবে। প্যাসেঞ্জারগুলো গাড়িতে ওঠার আগে বৈষ্ণব থাকে, মিটার ডাউন করলে তান্ত্রিক হয়ে যায়।
দরজায় শব্দ হতেই পেছনে তাকাল। অঞ্জনা ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বেশ অপরাধীর গলায় বলল, ‘যেতে পারলাম না। বাস চলছে না। আবার জোরে বৃষ্টি আসছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব।’ ‘চা বানাচ্ছি। চা খান।’ ‘আপনি সরুন, আমি বানাচ্ছি।’
সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়াল অজয়। আর তখনই তার মনে হল, ঘরে একটাও বিস্কুট নেই। শার্টটা চাপিয়ে, ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে পড়ল। মুদির দোকানের ঝাঁপ খোলেনি। আশপাশের দোকানও বন্ধ। চার ধার ভিজে স্যাঁতসেতে হয়ে আছে। এই সময় ঝেঁপে বৃষ্টি আসতেই সে দ্রুত একটা বন্ধ দোকানের লম্বা শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে বৃষ্টির জল থেকে বাঁচতে একজন চলে এল।
বৃষ্টি দেখতে দেখতে ছটফট করছিল অজয়। হঠাৎ খুব পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে এলে, ‘ভাই অজু, এটা তুমি কী করছ? অচেনা মেয়েমানুষকে ঘরে তুলেছ?’ চমকে পাশে তাকাতেই অজয় বৃদ্ধের কাতর মুখ দেখতে পেয়ে বলে ফেলল, ‘আপনি!
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
(ক্রমশ)
|
|
|
|
|
|