|
|
|
|
|
|
কথোপকথন |
সব ঝিনুকেই মুক্তো খুঁজি |
সপ্তমীর দিন জন্ম। নাম হল ‘ঝামেলা’। ‘দুঃখ’ মানে আবার কী? আনন্দের চশমায় জীবনসমুদ্র
দেখলে মণিমুক্তোর অভাব হয় না। জীবন-পুজোর গল্প পথিক পণ্ডিতকে বললেন নির্মলা মিশ্র
|
ব্রাহ্ম মুহূর্তে জন্ম। দুর্গা সপ্তমীর দিন, বৃহস্পতিবার। বাড়ির পিছনে একটা বস্তি ছিল। বস্তির লোকেরা বাড়ি বাড়ি কাজকর্ম করে খেত। মা খুব দয়ালু ছিলেন। ছোটবেলায় পুজোর সময় মাকে দেখতাম বস্তির প্রত্যেককে জামাকাপড় কিনে দিতে। এবং পুজোর কোনও এক দিন ভাল করে তাদের খাওয়ানো হত। (এ কথাগুলো বলতে বলতেই বাড়িতে কাজের লোক প্রবেশ করলেন।) কাজের মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, জানো, এ মাধ্যমিক পাশ! কী কপাল বলো। বলেছিলাম, তুমি আমার কাছে এলে না কেন? আরও পড়াতাম।
কোনও দিন শান্ত ছিলাম না জানো। আজও সমান দুষ্টু। ছেলেবেলার সেই দস্যিপনার জেরে মা নাম রাখতে বাধ্য হলেন ‘ঝামেলা’। বেশির ভাগই ছেলেবন্ধু। ভীষণ ডানপিটে ছিলাম তো। পাড়ার সবাই এসে কমপ্লেন করত মা’র কাছে, ‘দেখুন আপনার মেয়ে পেয়ারা পেড়ে নিয়েছে, আম পেড়ে নিয়েছে, এটা ভেঙে দিয়েছে, ওটা ফাটিয়ে দিয়েছে।’ সেই জন্য মা রেগেটেগে গিয়ে নাম ‘ঝামেলা’ দিয়ে ফেলেন।
একটা জিনিসে খুব ভয়, সেটা হল মদ আর মাতালদের। কেউ যদি আমাকে জব্দ করবে ভাবে, এক জন মাতালকে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। ব্যস, তা হলেই কেল্লা ফতে।
এই মাতাল নিয়ে একটা মজার গল্প বলি শোনো। বিদেশে যখন অনুষ্ঠান করতে যাই, উদ্যোক্তারা আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘উনি কোন ড্রিঙ্কস পছন্দ করেন?’ কর্তা বললেন, ‘খবরদার, আর এক বারও ওই নামটি উচ্চারণ করবেন না, তা হলেই মুশকিল।’ ১৯৯১ সালে প্রথম বার বিদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে হঠাৎই দেখতে পেয়েছি জহর রায়কে। হয়তো উনি ওই শহরেই কোনও কাজে গিয়ে থাকবেন। আমি দেখেই চিলচিৎকার করে উঠেছি ও জহরদা, ও জহরদা বলে। জহরদা দেখি ব্যাক গিয়ার দিচ্ছে। বলি, ব্যাক গিয়ার দিচ্ছেন কেন? আমি আবার ইশারাটিশারা কিছু বুঝতে পারি না। যা বলবে সরাসরি বলতে হবে। সে বার ন’দা সঙ্গে গিয়েছিলেন। ন’দাকে দেখি ইশারা করে কী যেন বলছেন জহরদা। আমায় নিয়ে চলে যেতে বলছেন হয়তো, নাকি কে জানে? আর ন’দা আমায় বললেন, ‘চল, চল, জহরদা এখন ব্যস্ত আছেন।’ বললাম, জহরদা ব্যাক গিয়ার দিচ্ছে কেন গো, ন’দা? খেয়ে বসে আছে যে, সেটা তো আর জানি না। তাঁর মতো শিল্পীর আমাকে এই রেসপেক্ট দেওয়ার দরকার ছিল কি? জানি না।
বাবার তিনটে টাইটেল ছিল। টাইটেল পেতে গেলে কাশী সঙ্গীত সমাজে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হত। ওখানে প্রচুর বড় বড় লোকেরা যেতেন। প্রথমে পেলেন পণ্ডিত, তার পর সঙ্গীতরত্ন, তার পর সঙ্গীতনায়ক। অর্থাৎ বাবার নাম সঙ্গীতরত্ন সঙ্গীতনায়ক পণ্ডিত মোহিনীমোহন মিশ্র। বাবা লোককে গান শেখাতেন, কখনও পয়সা নিতেন না। মা ভবানীদেবী। মা ঠাকুরটাকুর নিয়ে থাকতেন। মা বিশাল বড় লোকের বাড়ির মেয়ে, আর বিয়েও হয়েছিল বিরাট জমিদার পরিবারে। কত পুরুষের জমিদারি বলতে পারব না, তবে ‘মিশ্র’ আমাদের রাজখেতাব। আসলে আমরা বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমন্তদার ঠাকুরদা আর আমার ঠাকুরদা আপন মামাতো-পিসতুতো ভাই। জয়নগরের মজিলপুরে আমাদের আদি বাড়ি, আর হেমন্তদাদের বাড়ি পাশেই বহড়ুতে। তার পর বাবা গানবাজনার জন্য চেতলায় চলে আসেন। চাকরি করতেন মার্চেন্ট অফিসে। |
|
গ্রাফিক: অরিন্দম মজুমদার |
ছেলেবেলায় এত মজা করতাম যে, ‘দুঃখ’ শব্দটার মানেই জানতাম না। কষ্ট বলতে বাড়ির কেউ মারা গেছেন, তখনই একমাত্র দুঃখ হত। বাবা মৃত্যুটাকে খুব সুন্দর করে বোঝাতেন। বলতেন, ‘মৃত্যুটা কিছু না, ধরো তুমি নতুন একটা জামা কিনে পরলে, পুরনো হয়ে গেলে কী করো, ফেলে দাও। সে রকমই আমাদের ভেতরে একটা আলো বা আত্মা আছে। আত্মাটা এখান থেকে চলে গিয়ে আর একটা নতুন জামার ভিতরে ঢুকে যায়।’
আমার জন্ম মহাসপ্তমীর দিন তো, তাই পুজোর সময় ওই দিনটাই বাড়িতে হইহই রইরই কাণ্ড হত। মাছের মধ্যে আমি চিংড়ি খুব পছন্দ করি। অন্য মাছ অতটা না। সেই চিংড়ি মাছ আসত বাড়িতে, এক একটার সাইজ ইয়াব্বড়। একটা বড় প্লেটে ধরত না। অনেক বড় বয়স অবধি, মানে তখন নিয়মিত প্রোগ্রাম করি, নিজে হাতে খেতে পারতাম না জানো। মা কোলে বসিয়ে যত্ন করে খাইয়ে দিতেন। যখন বাইরে কোনও অনুষ্ঠান করতে যেতাম, তখন সঙ্গে যিনি যেতেন, তিনি খাইয়ে দিতেন। এখন অবশ্য নিজে নিজেই খাই, খেতে বাধ্য হই আর কী! কিছু করার নেই তো। আসলে বড্ড আদরের ছিলাম। এই আদরের আর একটা কারণ আছে। আমার মেজদা (প্রয়াত মুরারিমোহন মিশ্র) খুব ভাল গান করতেন। তাঁর নামে মিউজিক কম্পিটিশন এবং কনফারেন্স হত। ‘মুরারি স্মৃতিবার্ষিকী’। মেজদা টাইটেল নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন লখনউতে। দাদাকে খুব দুঃখজনক ভাবে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। এ ব্যাপারটা আমাকে আমার বাড়ির লোকেরা বলতে বারণ করেন, কিন্তু কেন আমি বারণটা শুনব? ওখানে অনেক বড় বড় শিল্পীই গিয়েছিল, মেজদার গান সবার ভীষণ ভাল লেগেছিল। খুব হইহই, রইরই পড়ে গেল, অন্য শিল্পীরা গেল খেপে। মেরে দাও। মেরে দিয়েছিল। আমি নাকি সেই দাদার মতো দেখতে হয়েছি। তফাতের মধ্যে সে ছেলে ছিল, আমি মেয়ে। সে জন্য বাড়িতে আমার আদরটা ছিল বরাবরই একটু বেশি। বাবার তো ভীষণই প্রিয় ছিলাম।
বাবার সঙ্গেই কাটত আমার বেশির ভাগ সময়টা। সব বাজনা বাজাতে পারতেন, বাবা নিজে তিনটে বাজনা তৈরি করেছিলেন সুরায়ন, সুরচয়ন, সুররঞ্জন। সুরায়ন যেটা, সেটা খান সাহেবের খুব পছন্দের ছিল। বড়ে গুলাম আলি খান আমার জন্য ওষুধ তৈরি করে দিতেন। ছোটবেলায় খুব ভুগতাম তো। ছেলেবেলায় ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবের কোলেপিঠেই থাকতাম অনেকটা সময়। আমাদের বাড়ি এমনিতেই গান-বাজনা চর্চার কেন্দ্র ছিল। সারাক্ষণ চলত গান-বাজনার আসর। সে আমলের উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের দিকপালরা প্রায় সকলেই আসতেন।
ছোটবেলায় ভীষণ কৌতূহলী ছিলাম। বাড়ির লোকেদের প্রচুর এলোমেলো প্রশ্ন করতাম। যেহেতু বাবার সঙ্গেই বেশির ভাগ সময়টা কাটত, সে কারণে বাবাকেই আমার প্রশ্ন-বাণ সহ্য করতে হত। অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে বাবাকে সারা দিনরাত জেরবার করে দিতাম। এক সময় এমন হয়েছিল, আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাবা বইপত্র কিনে নিয়ে আসতেন।
ভীষণ মারকুটে ছিলাম। কারও সঙ্গে মারপিট করলেই তার নাক-মুখ ফাটিয়ে দিতাম। একটা ঘটনা বললেই বুঝতে পারবে। আমরা ছ’জন ঘুরতে বেরিয়েছি। চেতলা ব্রিজটা তখন কাঠের ছিল। আমরা তিন বোন, আরও অন্য তিন জন, ওরাও তিন বোন। ওরা থাকত শিলংয়ে। দেখতে দেখতে যাচ্ছি সব। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, একটা লোক রাস্তায় হাঁটছে আর মেয়েদের বিশ্রী ভাবে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম, এর পর আমাদের পালা। আমি, শীলা আর শক্তি। শীলা মাঝখানে, আমি ও শক্তি দু’ধারে। লোকটা আমাদের সামনে এসে গিয়েছে, বুঝতে পারছি এ বার শীলাকে ধাক্কা মারবে। অমনি শীলাকে টাক করে সরিয়ে দিয়েছি। লোকটা হুস করে মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ও মা, তৎক্ষণাৎ দেখি লোকটা রেগে গিয়ে আমার পিঠে গুম করে এক কিল বসিয়ে দিয়ে, দে দৌড়! আশ্চর্য! পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটা দৌড়ে পালাচ্ছে। যাবে কোথায় বাপু! তার পিছু নিলাম। প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়ে লোকটাকে পাকড়াও করলাম। এবং মেরে তার নাক ফাটিয়ে দিলাম। লোকজন জমে গেল। সবাই জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘এই ঝামেলা, কী হয়েছে রে?’ বললাম, ওকেই জিজ্ঞেস করো, কী হয়েছে। ধীরে ধীরে ভিড় ফাঁকা হল, আমরাও আবার ঘুরতে চলে গেলাম।
বাবা খুব কড়া ধাতের লোক ছিলেন। অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনের দ্বিতীয় দিনে ধ্রুপদ গাইব। বাবাকে একটা ধ্রুপদ শেখানোর জন্য বলতেই বললেন, ‘কাল গাইবে, আর আজ তুমি বলছ দেখিয়ে দাও না। তুমি কি আমার নাম ডোবাবে?’ মা’র অনেক কাকুতিমিনতিতে বাবা রাজি হলেন। এই টুলটা দেখছ, (পাশেই একটা টুল রাখা ছিল) এই টুলের ওপর মা বসিয়ে দিয়ে গেল। বাবা বললেন, ঠিক আছে, এক বারের বেশি দেখাতে পারব না। মাকে বললেন, ‘রেণুর (মুরারি) খাতাটা বের করে দাও তো।’ মা বার করে দিল। শুধু গানটা তুলে দিলেন। সারা রাত বারান্দায় পায়চারি করে গানটা মনে গেঁথে নিলাম। ভোর চারটের সময় উঠে বাবাকে তুলে বললাম, পাখোয়াজ নামান, গাইব। মাকে তুলে বললাম, পাখোয়াজের জন্যে আঠা মাখো। সেজদি, ন’দিকে তুলে তানপুরাটা বাঁধতে বললাম। সবাই উঠে পড়ল। মায়ের কোলে বসে গানটা গাইলাম। গানটা শেষ হতেই বাবা আমায় বুকে নিয়ে করুণ সুরে মাকে বললেন, ‘দেখছ, আমার রেণু ফিরে এসেছে।’ ওই প্রথম এবং ওই শেষ বাবার চোখে জল দেখেছিলাম। আমার গান শুনে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা বলে মনে করি।
এক বার রামদাসবাবাজিকে পোস্তার রাজবাড়িতে দেখেছিলাম। দেখি বুড়োরা এসে ওঁর পা টিপে দিচ্ছেন। দেখে খুব রাগ হল। আমি ধাঁই করে এক ঘা মেরে দিলাম রামদাসবাবজিকে। বললাম, তোমার চেয়ে ওরা বড়, তোমার পা টিপছে, তুমি কিছু বলছ না কেন? উনি আমার দিকে অনেক ক্ষণ চেয়ে দেখলেন। কিছু বললেন না। পরে মাকে কী সব বলেটলেছিলেন।
দাদামণি (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য) আমার ‘মধুসূদন দাদা’ ছিলেন। উনি আমাকে ‘মিলনচক্র’ বলে কম্পিটিশনে নিয়ে গিয়েছিলেন। বয়স তখন ৭-৮ বছর হবে। দাদাকে বললেন, ‘নিয়ে যাবেন গান করিয়ে দেব।’ ওখানে গেলাম। গান আর করতেই দেয় না। তখন আমি কাউকেই চিনি না। কে আলপনা ব্যানার্জি, কে প্রতিমা ব্যানার্জি, কে উৎপলা সেন, কে ইলা বসু। ক্লাসিকালের সবাইকে চিনি, কিন্তু এঁদেরকে চিনতাম না। পরে অবশ্য এঁদের গান স্টেজের এক কোণে বসে মন দিয়ে শুনতাম। এ সব জলসায় উৎপলাদি কখনও স্নেহবশত আমাকে আগে গাইতে পাঠিয়ে দিতেন। এ রকম ভালবাসা সবার কাছে পেয়ে এসেছি। যা-ই হোক, মিলনচক্রের কম্পিটিশনে গান করব ভজন। তখন পঙ্কজ মল্লিক স্টেজে গান করছেন। আমি তখন খুব রেগে কাঁইকাঁই করছি। ছোটবেলায় সাদা পোশাক পরতে খুব ভালবাসতাম। খুব সুন্দর ফ্রকট্রক পরে গেছি। লোকটা গাইছে তো গাইছেই, নামছে না কেন বলো তো? দাদাকে প্রশ্ন করছি, বড়দা, আমায় কখন গাওয়াবে? বড়দা বললেন, ‘তুমি শান্ত হও, ঠিক সময় হলেই গাওয়াবে।’ হঠাৎ দাদামণি স্টেজ থেকে নেমে এসেছেন। একটু চেঁচামেচি করছিলাম তো, কানে গেছে। বললাম, তোমরা আমায় গান করতে দিচ্ছ না কেন? কখন থেকে বসে আছি। দাদামণি বললেন, ‘জানো কে গাইছেন?’ না আমি চিনিটিনি না। ‘তুমি এর পরে গাইতে পারবে?’ কেন পারব না, আমি আমার বাবার মেয়ে না! আমার বাবাকে নিয়ে ভীষণ গর্ব ছিল, অবশ্য এখনও আছে। ‘শোনো, তুমি একটার বেশি গাইবে না। মনে থাকে যেন।’ ঠিক আছে। উনি উঠে ভাল করে অ্যানাউন্স করে দিলেন একটা বাচ্চা মেয়ে আপনাদের গান শোনাবে। আপনারা ভাল করে ধৈর্য ধরে বসুন, শান্ত হয়ে শুনবেন। একটি মাত্র ভজন গেয়েছি, ‘কাহেকো বিশ্বজিরে জপ করো মালা...’ ও মা! শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘আর একটা, আর একটা... শুনব’। তখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তবলা নিয়ে বসে গেলেন।
বললেন, ‘গাও, গাও।’ গাওয়া শেষ হলে, বড়দা আমায় কোলে করে স্টেজ থেকে নামিয়ে নিলেন। আমার সেজদা, যে দাদা আমায় ‘নির্মলা মিশ্র’ করেছেন, উনি বলে গিয়েছিলেন যদি কখনও আপদে-বিপদে পড়ো, সোজা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে চলে যাবে। উনি সব সমাধান করে দেবেন।
ছ’বার টাইফয়েড হওয়ায় দুটো চোখ প্রায় অন্ধই হয়ে গেল। তার পর দেখা গেল হার্টটাও নাকি খুব দুরবস্থায় রয়েছেন! (সঙ্গে বললেন, এমনি ‘হার্ট’ কিন্তু আমার খুব ভাল। বলে খানিক হা হা করে হেসে নিলেন) ডাক্তার সব কিছু করা বারণ করে দিলেন। এক দিন সেজদা বাবাকে বললেন, ‘বাবা, ও কী নিয়ে থাকবে?’ বাবা বললেন, ‘কী নিয়ে থাকবে মানে, যেমন আছে তেমনই থাকবে। ভগবান তো সবাইকে সব কিছু দেন না?’ দাদা বললেন, ‘ওকে যদি লাইট মিউজিকে নিয়ে আসি?’ বাড়িতে তখন লাইট মিউজিকের চৌকাঠ পেরোবার হুকুম ছিল না। বাবা বললেন, ‘আমার মেয়ে হয়ে লাইট মিউজিক করবে? তোমার সাহস তো কম নয়!’ দাদা বললেন, ‘আচ্ছা, বাবা, সা রে গা মা বাদ দিয়ে আজ পর্যন্ত কোনও গান হয়েছে?’ বাবা খানিকক্ষণ সেজদার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ওকে আজ থেকে তোমায় দিয়ে দিলাম।’ সেজদাই নির্মলা মিশ্র বানিয়েছেন। বাবা আমার উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের গুরু ছিলেন, আর আধুনিক গানে যাঁকে গুরু বলে মানি তিনি নচিদা, নচিকেতা ঘোষ। উনি দ্রোণাচার্য, আমি একলব্য। আজ পর্যন্ত ওই রকম গাইতে কাউকে দেখিনি। আমার যে গায়কী অনেকটা নচিদার কাছে পাওয়া। এক দিন নচিদা ডেকে পাঠালেন বাড়িতে। গেলাম। চা-জলখাবার খাওয়া হল। নচিদা একটা গান শোনালেন। বললেন, লতা মঙ্গেশকরের জন্য ভেবেছি। মুখভার করতেই নচিদা বললেন, ‘এক ক্যারাবিয়ান সিঙ্গারের একটা হামিং শোনাব, তুই ওটা করতে পারলেই গানটা তোর।’ এক চান্সে পাশ, সঙ্গে গানটাও ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না...’ এ রকমই মজার মজার ঘটনা আছে অনেক গান নিয়েই। প্রবীর মজুমদারের কাছ থেকে এ রকম কাঁইকাঁই করেই পেয়েছিলাম ‘ও তোতা পাখি রে...’
তবে মজার ব্যাপার হয়েছিল ফুলশয্যার রাতে। আমার স্বামী আংটি বিনিময়ের আগে উপহার দিলেন একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা, ‘আমি যে তোমার চিরদিনের হাসি কান্নার সাথি’। আমি ব্যাপারটা না বুঝে ওকে বললাম, অ্যাই আংটি কোথায়? আংটি দাও। এটা নিয়ে কী করব? ভয়ে তিনি আংটিও পরিয়ে দিয়েছিলেন। সে যা-ই হোক, পরবর্তী কালে ওই চিরকুটে লেখা গানটির জনপ্রিয়তার কথা সবারই জানা।
বিয়ে হয়েছিল একটু বেশি বয়সে। ওর (প্রদীপ দাশগুপ্ত) সঙ্গে ডাবিং সিনেমায় ডুয়েট গান করতাম। অথচ ওকে ঠিক চিনতাম না তখন। খুব শান্ত ছেলে। মাদ্রাজি ছবিগুলো বাংলায় ডাবিং হত। এই জন্য হেমন্তদা আমায় ‘ডাবিং কুইন’ নাম দিয়েছিল। এত কুইক করে ফেলতাম। পুজোর গান রেকর্ড করা হবে। চরম ব্যস্ততা। আমাদের বাড়ি এসেছে। আমি বললাম, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? বড্ড চেনা চেনা লাগছে। ও বলল, ‘আপনার সঙ্গে প্রচুর গানটান গেয়েছি, হয়তো তখনই দেখে থাকবেন।’ মনে পড়ল। তার পর দেখি ও আমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। আমি বললাম, কী ব্যাপার? অমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? আমতা আমতা করে বললে, ‘না, না, আসলে এমনি...।’ ও খুব ভিতু তো। মা মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলেন ওই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। আমি তো রেগে গরগর করছি। আমি টারজানকে পছন্দ করি, আর তুমি কি না একটা রোগাপটকাকে নিয়ে এসেছ। আমি বিয়ে করব না। তার পর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মারা যাওয়ার সাত দিন আগেও মা আমায় খাইয়ে দিয়েছেন। ওই সময় এক দিন খাওয়াতে খাওয়াতে মা বললেন, ‘শোন, আমি বলছি, ও আমার মতন করে তোকে আগলাবে। ওর হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হব।’
উত্তমদার জন্মদিনে প্রত্যেক বার ওঁর বাড়িতে আমায় ডাকতেন। বলতেন, ‘নির্মলা, একবারটি আয় বোনটি, বেণু তোর জন্য ভাল চিংড়ি রান্না করেছে।’ গেলাম। গেলেই শোনাতে হত আমার বরের লেখা একটি গান। ‘ছোট্ট সে কথা ভালবাসা, বিপুল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে কাব্যে ধরা, এই অল্প কথা জীবনে অনেকখানি জড়িয়ে আছে...’ যেখানেই দেখা হত সেখানে বলতেন, ‘একবার গা।’ আর শুনে হাউহাউ করে কাঁদতেন। তার পর তো এই গানটা উত্তমদার কথামতো পুজোর রেকর্ড করেছিলাম।
বোম্বেতে যেমন লতাজি কুইন, কলকাতায় সন্ধ্যাদি, ওড়িশার কুইন বলা হত আমাকে। এ বছরের ১ জুন ওরা বিরাট করে আমায় সংবর্ধনা দিল। ভুবনেশ্বরে। এয়ারপোর্টে নেমে দেখি চারিদিকে থিকথিক করছে কালো কালো মাথা। ি এত ভিড়, এক কাপ যে চা খাব, সেটা খাওয়ারও জো নেই। এই রকম ভিড় উত্তমদা মারা যাওয়ার সময় দেখেছি। এ সব তো বড় বড় মানুষদের হয়। আমার ক্ষেত্রে কেন? তখন মনে মনে ভাবলাম, আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি! খুব আনন্দ হয়েছিল। সে যা-ই হোক, আমার পাশে দেখি একটা হুইল চেয়ার রাখা আছে। ওরা ভেবেছিল আমি আর হাঁটতেটাঁটতে পারি না। কিন্তু আমি তো গটগট করে হেঁটে স্টেজে উঠে গেলাম। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, এই হুইল চেয়ারটা কেন? ওরা লজ্জায় বলতে পারেনি।
আমি গান গাওয়ার জন্য টাকা বা রেকর্ড বিক্রির টাকা ছুঁই না। আমার নিজস্ব পয়সা বলতে যাদের গান শেখাই, তাদের কাছে যেটা পাই, সেটাই আমার গাঁটের কড়ি। এই কড়িই যাঁরা খেতে পাচ্ছে না, রোগ হয়েছে ডাক্তার দেখাতে পাচ্ছে না, যারা জামাকাপড় পরতে পারছে না, তাঁদের অল্পস্বল্প দিই। ‘এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যার মুক্তো আছে, এমন একটা মানুষ খুঁজে পেলাম না যার মন আছে...’ এটা আমার গানের বিখ্যাত লাইন হলেও, লাইফে আমি কিন্তু ‘মুক্তো’ এবং ‘মন’ দুইই পেয়েছি।
এখন অনুষ্ঠান করি। কিন্তু আর আগের মতো ভাল লাগে না। কিন্তু আর্টিস্ট মহলের কাউকে দেখলে সেটা টনিকের মতো কাজ করে। আমি এখন ইন্টারন্যাশনাল পিসিমা। আমার এখন ২৭, সামনের বছর ৩৭-এ পড়ব! কী বুঝতে পারলে না তো, উল্টে দেখো পাল্টে গেছে। পুজো সব্বার ভাল কাটুক। |
|
|
|
|
|