|
|
|
|
|
যে সুড়ঙ্গপথে আটকে ইতিহাস |
যেখানে চলেফিরে বেড়াতেন দেবী চৌধুরাণী! ওই মন্দির, সেখানে মা কালী এখনও
ভারতমাতা রূপে পূজিতা। ইস্পাতনগরী দুর্গাপুর, ইতিহাসের গন্ধে ম’ম। সুপর্ণা ঘোষ |
এই সেই সুড়ঙ্গ পথ, যা কিনা দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক চলাফেরার জন্য ব্যবহার করতেন! এ তো ভাবাই যায় না। আর আমরা কিনা সেই সুড়ঙ্গ মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি! দেবী চৌধুরাণী, নামেই তো রোমাঞ্চ জাগে মনে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ পড়ার পর, সুচিত্রা সেনের দাপুটে অভিনয় দেখার পর শিহরন মিশ্রিত চরিত্রটি অনেকটাই কল্পনা থেকে বাস্তবে। কিন্তু তাই বলে ওঁদের ব্যবহৃত সুড়ঙ্গ পথটি মাটির তলা থেকে অমন হুড়মুড় করে চোখের সামনে বেরিয়ে আসতে পারে তা কল্পনাতেও ছিল না। আর তা-ই কিনা ঘটে গেল খননকার্য চালাতে গিয়ে, কী রোমাঞ্চকর ব্যাপার! এই রকম এক ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গ পথ চাক্ষুষ না করলে হয়?
দল বেঁধে এখন আমরা সেই সুড়ঙ্গপথের সামনে! কলকাতা থেকে বেশি দূরের পথও তো নয়, কাছেই ইস্পাতনগরী দুর্গাপুর। এখন না হয় ঝাঁ-চকচকে, সুন্দর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর ভারতের। কিন্তু এক সময় তো ছিল বেশির ভাগ অঞ্চল জুড়েই ভয়াবহ ঘন গভীর জঙ্গল ও রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া ডাকাতদলের স্বর্গরাজ্য! এ হেন দুর্গাপুরের বর্তমান প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারেই এই সুড়ঙ্গপথটি আবিষ্কার হয়েছে, সিটি সেন্টার মোড় থেকে খুব কাছেই। প্রবেশ পথের মুখেই বিজ্ঞপ্তি পড়ে জানা গেল আগাগোড়া চুন-সুরকি, বালি, ও বেলেপাথরের খণ্ডে খিলানসহ তৈরি এই রোমান স্থাপত্যের সুড়ঙ্গ পথটির নির্মাণকাল সতেরো শতক, মুঘল শাসনের শেষের দিকে। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ এই পথটি জল সরবরাহ ও অতিরিক্ত জল নির্গমের কাজেও বহুল ব্যবহৃত হত আবার পলায়নের গোপন পথ হিসাবেও ব্যবহৃত হত! সুতরাং এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। |
|
খননকার্যের ফলে বেশ কিছুটা অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে, এঁকেবেঁকে চলে গেছে পথটি। তবে বহু এলাকা জুড়ে ঘরবাড়ি হয়ে গেছে বলে সুদূর বিস্তৃত সুড়ঙ্গ পথটির সম্পূর্ণ খননকার্য করা আর সম্ভবই নয়! তবু যেটুকু চাপা পড়া ইতিহাস আজ আবার আমাদের সামনে তা-ও বা কম কী! অন্ত-মধ্যযুগীয় এই স্থাপত্যটি দুর্গাপুর শিল্পনগরীর বিস্মৃত সময়কালের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন-নিদর্শনও বটে! সুড়ঙ্গ পথের প্রায় গায়েই আরও দু’টি নিদর্শন, যা না দেখলেই নয় ইছাই সরোবর। বিশাল এই সরোবরটিতে দেবী চৌধুরাণী-ভবানী পাঠক স্নান করতেন। যদিও সরোবরটি জুড়ে কংক্রিট জঙ্গলের প্রজেক্ট চলছে মাটি চাপা পড়েছে বহু জায়গায়! ঐতিহাসিক সরোবর আবার কি তবে ইতিহাসের পাতায় স্থান নেবে, মাটি চাপা পড়েই কী জানি!
পাশেই বহু প্রাচীন এক কালীমন্দির যা ভবানী পাঠকের মন্দির নামেই বহুলপরিচিত। যদিও লেখা দেখলাম ‘দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক ভারতমাতার আশ্রম’! মন্দির অথচ আশ্রম! এখনও কেমন গা-ছমছমে পরিবেশ, বট-অশ্বত্থের আড়ালে ঢাকা। ভারতমাতা আশ্রম কেন তার রহস্যও জানা গেল মন্দিরের এক পূজারির থেকে। প্রায় আনুমানিক ৫০০-৭০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির। ভবানী পাঠক পরবর্তী কালে এখানে সাধনা করেছেন বলে মন্দিরটি ভবানী পাঠক মন্দির রূপে জনপ্রিয়। কিন্তু প্রধান বৈশিষ্ট্য, এখানকার কালী-মা’কে ‘ভারতমাতা’ রূপেই পুজো করা হয়, কালী-মা’কে ভারতবর্ষে আর কোথাও ভারতমাতা রূপে পুজো করা হয় কিনা, জানা নেই অবশ্য। জানা গেল ব্রিটিশ আমলে অনেক সময়ই বিপ্লবী দল এই আশ্রমে এসে আশ্রয় নিতেন, আর তাঁরাই দেবীকে ভারতমাতা রূপে পুজো শুরু করেন। সেই থেকে এখনও এই মন্দিরে কালী-মা’কে ভারতমাতা রূপেই পুজো করা হয়। |
|
ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিচরণ করে ইস্পাতনগরীর আধুনিকতাও স্পর্শ করল যেন। এই সিটি সেন্টারেই রয়েছে আবার ‘ত্রোইকা পার্ক’। রোপওয়ে থেকে বোটিং, টয় ট্রেন, সব আধুনিকতাই মজুত! পশ্চিমবঙ্গের খুব কম পার্কেই রয়েছে রোপওয়ে চড়ার আনন্দ তা-ও এখানে মিলবে! আর কিছুটা পথ এগিয়ে গেলে রয়েছে ‘কুমারমঙ্গলম পার্ক’। যা না দেখে ফিরে চলে এলে আফসোস থেকে যেতে পারে মনে।
ইতিহাস ও আধুনিকতার সহাবস্থান তো বটেই, এই দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করেই কিন্তু ঘুরে নেওয়া যায় এক দিকে বিষ্ণুপুর, মুকুটমণিপুর, তো অন্য দিকে মাইথন, পাঞ্চেত, গড়পঞ্চকোট আরও কত্ত জানা-অজানা জায়গা। দু-তিন দিনের ছুটি পেলেই হল হইহই করে বেরিয়ে পড়া দল বেঁধে মন্দ লাগবে না। |
ছবি: লেখক |
|
|
|
|
|