জোর যার, শূন্য তার
রাস্তার ওপর একটি লাইন আঁকা। বস্তুত, খোদাই করা। সেই লাইনের দু’দিকে দু’টি পা রেখে যদি আপনি দাঁড়ান, তবে আপনার দেহের একটি অংশ থাকবে পূর্ব গোলার্ধে, অন্য অংশটি পশ্চিম গোলার্ধে, আপনার শরীরে মিলন ঘটবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের, আপনিই একাধারে হয়ে উঠবেন রবিশঙ্কর এবং মেনুহিন। কারণ, আপনি তখন দাঁড়িয়ে আছেন গ্রেনিচ-এর মানমন্দিরের সামনে, ‘গ্রেনিচ মিন টাইম’ বা জি এম টি’র উৎস-রেখায়। সময়ের সীমান্তে।
লন্ডন শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, টেমস নদীর ধারে, গ্রেনিচ এলাকায় ‘রয়াল অবজার্ভেটরি’টি তৈরি হয়েছিল ১৬৭৬ সালে, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আদেশে। তিনি চেয়েছিলেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা যেন এগিয়ে যায়, কারণ গ্রহনক্ষত্রের জ্ঞান যত বাড়বে, সমুদ্রপথে নাবিকদের দিকনির্দেশ করতে তত সুবিধে হবে। দেখতে দেখতে গ্রেনিচের এই মানমন্দির হয়ে উঠল ইয়োরোপে আকাশ পর্যবেক্ষণের একটি প্রধান কেন্দ্র।
ইতিমধ্যে সময় মাপবার কলাকৌশল নিয়েও নিত্যনতুন গবেষণা চলছে ইয়োরোপে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে। কিন্তু মুশকিল হল, সময় তো যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। একই দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে সময় পালটে যায়, এখানে সূর্য যখন মধ্যগগনে, ওখানে তখন তিনি আধশোয়া হয়ে পড়েছেন। তা-ও চলছিল এক রকম, সমস্যা হল রেল চালু হওয়ার পরে। রেল মানে টাইম টেবল। এ বার, গোটা দেশে যদি একটা সময় না থাকে, কলকাতা টাইম আর বধর্মান টাইম যদি আলাদা আলাদা হয়, তা হলে তো টাইম টেবল আর কেশব নাগের পাটিগণিতে কোনও ভেদ থাকে না। সুতরাং দরকার একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড টাইম’। প্রামাণ্য সময়। আর, রেলগাড়ি বস্তুটি যেহেতু ইংল্যান্ডেই প্রথম চলল, সুতরাং সেই দেশেই জন্ম হল স্ট্যান্ডার্ড টাইম-এরও।
গ্রাফিক: অরিন্দম মজুমদার
কিন্তু কোথাকার সময়টাকে প্রামাণ্য বলে ধরা হবে? বিশুদ্ধ ভূগোল যদি মানি, তবে মানচিত্রের মাঝ বরাবর একটা লাইন টেনে সেটা ঠিক করতে হয়। কিন্তু এ সব ব্যাপারে খেলাটা সচরাচর ভূগোলের হাতে থাকে না, চলে যায় ইতিহাসের হাতে। ইংল্যান্ডেও তা-ই হল। কোথাকার সময়কে সারা দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ বলে মানা হবে, সে প্রশ্নের উত্তরে একটি নামই ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠতে লাগল গ্রেনিচ। হবে না? একে গ্রেনিচ টাইম মানে লন্ডন টাইম, তার ওপর ওখানেই তো আছে রাজার আপন মানমন্দির! হ্যাঁ, অন্য নানা শহর গাঁইগুঁই করছিল, ‘আমরা কি টেমসের জলে ভেসে এসেছি’ গোছের অভিমানবাণীও শোনা গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ১৮৮০ সালে রাজার হুকুম জারি হল: দেশে একটাই অভিন্ন সময় মান্য হবে: গ্রেনিচ মিন টাইম।
দেশ তো হল, দুনিয়া? গোটা দুনিয়ার জন্য একটাই সময় থাকবে, এমন নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু বিভিন্ন দেশের সময়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র চাই। বাণিজ্য যত আন্তর্জাতিক হয়, দেশে দেশে, শহরে শহরে যোগাযোগ আর আদানপ্রদান যত বাড়ে, এই যোগসূত্রের প্রয়োজনও তত বাড়ে। লন্ডন জানতে চায়, প্যারিসের সঙ্গে তার সময়ের তফাত কত, কলকাতাই বা ঘড়ির কাঁটায় কত দূরে। যখন যেমন দরকার, তখন তেমন অঙ্ক কষে নেওয়া যায়, কিন্তু সেটা ঠিক কাজের কথা নয়। দরকার একটা মাপকাঠি, মানে এমন একটা সময়, যাকে সর্বত্র ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’ হিসেবে মেনে নেওয়া হবে, যেমন আমরা সংখ্যা গোনার সময় একটা শূন্য ধরে নিই, তার সাপেক্ষে অন্য সংখ্যাগুলিকে মাপি বাড়লে ধনাত্মক সংখ্যা, কমলে ঋণাত্মক। তার মানে, কোনও একটা দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড টাইম’কে সেই শূন্য’র স্থান পূরণ করতে হবে। কে হবে সেই দেশ?
১৮৮৪ সালে ওয়াশিংটনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হল: ইন্টারন্যাশনাল মেরিডিয়ান কনফারেন্স। ১৩ অক্টোবর সেখানে স্থির হল, গ্রেনিচ মিন টাইম হবে সময় মাপবার আন্তর্জাতিক শূন্য-বিন্দু, হিসেব রাখা হবে দুনিয়ার যে কোনও জায়গার স্থানীয় সময় গ্রেনিচের তুলনায় কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে। ‘শূন্য’ কথাটা কেবল রূপক বা তুলনা হিসেবে নয়, গ্রেনিচ বাস্তবিকই শূন্য-স্থান হিসেবে স্বীকৃত হল। পৃথিবী নামক (উত্তর দক্ষিণ কিঞ্চিৎ চাপা) গোলকটিকে লম্বালম্বি, মানে উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরু পর্যন্ত ১৮০টি বৃত্তাকার রেখায় ভাগ করা হয়, যাদের নাম ‘লাইন অব লঙ্গিটিউড’ বা দ্রাঘিমারেখা। একই রেখার ওপর যে কোনও জায়গায় একই সময়, একটি রেখা থেকে আর একটি রেখায় সময় পালটাতে থাকে পুবে গেলে সময় এগোয়, পশ্চিমে পিছিয়ে যায়। অঙ্কের হিসেবটা সোজা: পুব-পশ্চিম দু’দিকে ১৮০ ডিগ্রির পরিসরে ১৮০টি দ্রাঘিমারেখা, এক ডিগ্রিতে সময়ের তফাত চার মিনিট, ১৫ ডিগ্রিতে এক ঘণ্টা, ১৮০ ডিগ্রিতে বারো ঘণ্টা, পুব-পশ্চিম মিলিয়ে পুরো চব্বিশ ঘণ্টা। এই ১৮০টি বৃত্তরেখার মধ্যে যেটি গ্রেনিচ দিয়ে গিয়েছে, সেটিই নির্ধারিত হল ০ ডিগ্রি লঙ্গিটিউড হিসেবে। সব দেশ মানল না, কিন্তু বেশির ভাগই মানলও। দুনিয়া মেনে নিল জি এম টি’কে।
কেন মানল অন্যরা? এত দেশ থাকতে ইংল্যান্ড কেন হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক সময় গণনার ‘রেফারেন্স পয়েন্ট’। উত্তর: রাজনীতি। কিংবা, ক্ষমতা। উনিশ শতকের শেষভাগ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। এমন দেশটি আর কে কোথায় খুঁজে পাবে? অতএব, জোর যার, সময় তার।
বাকি ইতিহাস আমরা জানি। ছিল সাম্রাজ্য, হয়ে গেছে দ্বীপ। জি এম টি’র মহিমা খাটো হয়েছে, ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক সময়ের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ইউ টি সি কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম। তবু এখনও জি এম টি একেবারে ‘নেই’ হয়ে যায়নি, অনেক গণনাতেই তার উল্লেখ দেখি আমরা। তবে এ বার বোধহয় শেষের সে দিন সমাগত। মাত্র ক’দিন আগে জেনিভায় ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়ন-এর (আই টি ইউ) সভায় স্থির হয়েছে, জি এম টি’কে সম্পূর্ণ বিদায় জানানো হবে, আন্তর্জাতিক সময়ের হিসেব কষা হবে অ্যাটমিক ঘড়ি দিয়েই, পৃথিবীর ঘোরাফেরার সঙ্গে তার আর সম্পর্ক থাকবে না।
কিন্তু পৃথিবী নামক গোলকে শূন্য ডিগ্রির রেখাটি? সে তো গ্রেনিচ দিয়েই যাবে। তবু তো আমরা গিয়ে দাঁড়াব দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের মাটিতে আঁকা ওই ম্যাজিক-রেখাটির ওপর, দু’দিকে দুই পা রেখে, নিজের শরীরে পুব আর পশ্চিমকে অনায়াসে ধারণ করে। ইতিহাস কেন বাধ্যতে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.