|
|
|
|
স্মরণ ৩... |
মাকে দাহ করে কলকাতায় এসে শো করে গেলেন |
এই শহরে তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু বাদল ধরচৌধুরী। তাঁর ডায়েরির পাতায় অচেনা জগজিৎ সিংহ |
• ১৯৭৫। বিখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী সালামত খান সাহেবের সঙ্গে বোম্বে যাচ্ছি। বোম্বে এয়ারপোর্টে জগজিৎ সিংহের সঙ্গে দেখা। চিনি না ওঁকে। উনিও আমায় চেনেন না। সালামত খান সাহেবকে দেখে এগিয়ে এসে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। খান সাহেবই আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
• ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১। ২৩ সেপ্টেম্বর ওঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঠিক সাত দিন আগে। কত আড্ডা! রেস নিয়ে ওঁর খুব উৎসাহ। আমিও তো ও সবের খবর রাখি। সঙ্গীত ছাড়া আমাদের বন্ধুত্বের বড় কারণও তো
এই ঘোড়া-প্রেম। জগজিৎভাইয়ের সাত-আট খানা নিজের ঘোড়া। বেশ দেখতে পাচ্ছি মুম্বইতে থাকলে রোজ সকালে রেস কোর্সে মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছেন। আর ঘোড়াদের আদর করছেন। ১৬ তারিখও সে সব নিয়ে কত গল্প। নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কত রসিকতা ওঁর!
• ছেলের মৃত্যুর পর চিত্রাজি গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। জগজিৎভাইও ভেঙে পড়েছেন। আমরা, কাছের বন্ধুরা বোঝাচ্ছি গানই ওঁর বেঁচে থাকার পথ মন দিয়ে আমাদের কথা শুনেছেন। তারপর বলছেন, “হা। মিউজিক হি জিনে কা রাস্তা হ্যায়।”
• একটা বেসরকারি সংস্থা চালাই যেখান থেকে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাচ্চাদের লেখাপড়ার কাজে সাহায্য করা হয়। জগজিৎভাই আট বছর ধরে এই সংস্থার জন্য বিনা পয়সায় অনুষ্ঠান করে চাঁদা তুলে দিচ্ছেন। আমার বাড়িতে যেচে ওয়ার্কশপ করাচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের টিপস দিচ্ছেন।
• বছর চারেক আগের একটা দিন। জগজিৎভাইয়ের মা মারা গেছেন। সেই দিনই কলকাতার নজরুল মঞ্চে ওঁর অনুষ্ঠান। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। এ দিকে এত বড় একটা ব্যক্তিগত বিপর্যয়। কী বলব ওঁকে বুঝে উঠতেই পারছি না। মাকে দাহ করে বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা এসে শো’টা করে গেলেন জগজিৎভাই। যাওয়ার সময় বললেন, “কলকাতাকে না বলতে পারি না।”
• আমার মা খুব অসুস্থ। আর আমায় একটা কাজে সুরাতে যেতেই হবে। জগজিৎভাই কলকাতায় এসেছেন শো করতে। এয়ারপোর্টে নেমেই শুনেছেন আমার মা অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন, “ইয়ে ক্যায়া শুন রাহা হু?” আমি বলছি হ্যাঁ, আর এই অবস্থাতে আমি বাইরে। ওঁর উত্তর, “চিন্তা মত করো। ম্যায় সব দেখ লুঙ্গা।” দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সে দিন সোজা আমার বাড়ি চলে গেলেন জগজিৎভাই। মা’র সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। বাড়ির লোকদের সান্ত্বনা দিলেন বড় দাদার মতো। আর আমায় ফোন করে বললেন, টাকাপয়সা নিয়ে যেন না ভাবি। যা লাগে উনি দেবেন।
• চিত্রাজির আগের বিয়ের মেয়ে মণিকা আত্মহত্যা করল। আমেরিকার ট্যুর ক্যানসেল করে দেশে ফিরে এলেন জগজিৎভাই। ওঁর মতো শিল্পীর কাছে ট্যুর ক্যানসেল করা-- যেখানে তখনও চারটে শো বাকি, বিরাট ব্যাপার। মণিকার মৃত্যুর খবর পেয়ে সে সব আর ভাবলেন না। এতটাই স্নেহ। মণিকার
দুই ছেলে ওঁর আর চিত্রাজির কাছেই মানুষ। এখন বড় হয়ে গেছে। ১৭-১৮ বছর বয়স হবে।
• চিত্রাজিকে সঙ্গে নিয়ে রেওয়াজে বসেছেন জগজিৎভাই। রোজকার অভ্যেস। কখনও এক দু’জন ছাত্র-ছাত্রীও সঙ্গে। তবে প্রধানত চিত্রাজিই সঙ্গী ওঁর। ঘরের নানা কাজ করতে করতে দু’জনকে সুর বাঁধছেন। জগজিৎভাই টেলিফোনের বিল, ইলেকট্রিক বিল গোছাচ্ছেন আর সুর মেলাচ্ছেন, আর চিত্রাজি হাতের টানে কাজ সারতে সারতে।
• চুড়িদার পায়জামা আর একটু জমকালো একটা কুর্তা খুঁজছেন শো-এর আগে। পেলেন না। শেষে সাদা ফ্যাটফ্যাটে একটা সুতির কুর্তা পরে উঠে গেলেন গান গাইতে।
• কলকাতায় এসে আমায় বললেন ‘‘বনিয়ান খরিদনা হ্যায়।” নিজের জামাকাপড় নিজেই কেনাকাটা করতেন সব সময়। নিয়ে গেলাম গড়িয়াহাটে। পাঞ্জাবি-পায়জামা কিনে দিতে। ওঁকে দেখে লোকে ভিড় জমাতে শুরু করতেই পালাও পালাও! কী যে মজা হল।
• ওঁকে বলছিলাম উনিই গজলের শাহেনশা। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “গানা প্যার সে গানা চাহিয়ে। ইয়ে শাহেনশা-ফায়েনশা বেকার কি বাত হ্যায়।”
• আগামী ২৬ নভেম্বর। কলকাতায় ওঁর বিশেষ শো। ওঁকে ছাড়া সেই শো’র কী হবে, আদৌ হবে কি না এখনও ভেবে উঠতে পারছি না। এই প্রথম আপনি আমাকে বড় বিপদে ফেলে গেলেন জগজিৎভাই।
|
ফারুক শেখ
প্যার মুঝসে যো কিয়া তুমনে ‘সাথ সাথ’ ছবির ‘প্যার মুঝসে যো কিয়া তুমনে’ আমার খুব পছন্দের গান। লিপ দেওয়ার সময় অভিব্যক্তি কেমন হবে ইত্যাদি নিয়ে জগজিৎজির সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের আলাপ দীর্ঘ ৪৫ বছরের। পরবর্তীকালে টেলিভিশনে ‘জিনা ইসিকা নাম হ্যায়’ বলে একটা শো করতাম। তাতে জগজিৎজি অতিথি হয়ে এসেছিলেন। পরে যতবার দেখা হয়েছে বলেছেন “আমাকে নিয়ে একটা সেকেন্ড পার্ট করো শো’টার।” সেটা আর হল না! |
|
|
|
|
|
|