|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
শুধু স্বরক্ষেপে বোধহয় ঝর্ণা অতখানি জীবন পায় না |
দেবাশিস মজুমদার |
ফালতু লেখায় ফালতু কথা, রুশতী সেন। সূত্রধর, ২৫০.০০ |
শিল্পের স্রোতোধারায় দাঁড়িয়ে সময়ের সঞ্চয় যাঁরা করেন, তাঁদের কাজের ঋণ স্বীকার করে নেয় সমাজ ও সংস্কৃতি। হয়তো কখনও কখনও দেরি হয়, তবু তাকে গ্রহণ না করলে শেষ পর্যন্ত সমাজ ও সংস্কৃতিই দুঃস্থ হয়। তাই শিল্পে, বিশেষত আমাদের নাটকে এমন দুর্লভ উদাহরণ বড় মূল্যবান হয়ে ওঠে। এই কথাগুলি মনে হল সম্প্রতি রুশতী সেনের প্রবন্ধ সংকলন ফালতু লেখায় ফালতু কথা বইটি পড়া শেষ করে। প্রচলিত পাঠে আমাদের মন সজাগ থাকে, গবেষণা সঞ্চিত নাটকের ইতিহাস গ্রন্থে; যদিও প্রকৃত বিবেচনায় সব সময় যে সেই উপকরণ তৃপ্তি দেয় তা নয়। সে কষ্টের কথা মনে না রেখে, বরং উচ্চারিত হোক আমাদের প্রাপ্ত সংকলনের আনন্দধ্বনি। নাটক-চলচ্চিত্র-গল্প-গান সব কিছু এসেছে সমসময়ের আবর্তে। যার মধ্যে বিগত কালের চিহ্ন নেই, নেই ইতিহাস আহরণের রঙ-রেখার হিসেব। আজকের শিল্পের সঙ্গে প্রধান সম্পর্কের অনুভূতিকে ধরতে চেয়েছেন রুশতী। আর তাই সংকলনটি হয়ে উঠতে পেরেছে এই মুহূর্তের শিল্পের চলাচলের আন্তরিক সংকলন। যার পাঠে, দর্শক সন্ধান পাবেন ‘বিকল্প সাধনার স্বরূপ’ কিংবা ‘মুহূর্ত স্পন্দনের অনুভব’।
বিকল্প নাট্য নির্মাণের চেষ্টা যে আজকের অনুসন্ধান, তা তো নয়। সেই শুরুর ইতিহাস স্বাভাবিক ভাবে সাবেক, সে কথা সকল পাঠকই জানেন এবং মানেন এই বিশ্বাসে নির্ভর করে সংকলনের প্রথম রচনাটির শুরু ‘শম্ভু মিত্রের তিনটি অভিনয়’-কেন্দ্রিক। একেবারে গোড়ায় রুশতী প্রায় তিরিশ পৃষ্ঠায় নিজের ভাবনার সঙ্গে পাঠকের আলাপ বিস্তার করতে চেয়েছেন। সংকলনের বারোটি রচনার পটভূমি, এমনকি বিষয় নিয়েও তিনি জানাতে চেয়েছেন; সেই চাওয়ায় তাঁর শৈশব থেকে শিল্পের নিবিড় সম্পর্কের পরিচয় যেমন পাই, তেমনই সমসাময়িক অনুভবে নাটক এবং শিল্পের বিভিন্ন ধারার বিকল্প সৃজনে উৎস ও বিস্তার কী ভাবে প্রসারিত, তার সন্ধান দিতে পারেন পরিণত রুশতী। তিনি প্রশ্ন তোলেন: ‘কিন্তু এ রকম একটি সংকলনের আদৌ কি কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে পাঠকের কাছে?’ তারই উত্তর অনুসন্ধানে বলেন, ‘আমি যে আমার সমসাময়িকদের তুলনায় বাংলা গ্রুপ-থিয়েটারের বিখ্যাত প্রযোজনা খানিকটা বেশি দেখতে পেয়েছি, সে তো আমার কোনো কৃতিত্ব নয়! আমার আজন্ম পরিবেশ আমাকে সেই বাড়তি সুযোগ দিয়েছিল; আমার বালখিল্য-আমল থেকেই আমার অভিভাবকরা আমার সামনে তাঁদের সাবালক রুচি-পছন্দের ভাগীদার হওয়ার বিকল্প খুলে দিয়েছিলেন।’ সংকলনটির পাঠ শেষে রুশতীর অভিভাবকদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে ইচ্ছে করে। কারণ, প্রচলিত পথে এই বালিকা দর্শক যদি শম্ভু মিত্র অভিনীত নাটক না দেখতে পেত, তা হলে কেমন ভাবে লেখা হত ‘ডাকঘর’-এ সেই অভিজ্ঞতা “পঞ্চানন মোড়লের দেওয়া সাদা কাগজ দেখে অমল যখন অস্থির আকুলতায় জিজ্ঞাসা করত ‘এ কি সত্যি তার চিঠি?’ ঠাকুরদা উত্তরে বলত ‘হ্যাঁ বাবা, আমি ফকির, আমি বলছি এ সত্যি-সত্যিই তাঁর চিঠি।’ শম্ভু মিত্রের সেই বাচিক অভিনয়ে ‘তাঁর’ কথাটির উপর যে বাড়তি জোরটুকু পড়ত, তা অমলের ‘এ কি সত্যি তার চিঠি’-র আর্তিকে যেন বাড়তি অর্থের অবলম্বন এনে দিত।...এমন করে ‘ডাকঘর’-এর রাজা, অমলের চিঠির রাজা পরিপূর্ণ অর্থময়তায় নাটক জুড়ে ছড়িয়ে যেতেন।” কিংবা “শম্ভু মিত্রের বাচিক অভিনয়ে কোনখানে পৌঁছতে পারে, তার প্রমাণ অডিয়ো ক্যাসেটেও ধরা আছে। কিন্তু মঞ্চে ওই উচ্চারণের সঙ্গে-সঙ্গে ফকিরের হাত দু’টি ক্রৌঞ্চদীপের ঝর্ণার ছন্দে যে-নাচ নেচে উঠত, সেই অসামান্য মুদ্রা ছাড়া শুধুমাত্র স্বরক্ষেপে বোধহয় ঝর্ণা অতখানি জীবন পায় না।” এই মননে এবং গ্রহণে যে বালিকা নাটক দেখতে দেখতে পরিণত রেখা স্পর্শ করে, সে কি শুধুই এক জন দর্শক! রুশতী শুরুতেই বলেছেন “নাট্য প্রযোজনার অন্দরমহলের বাসিন্দা আমি কোনোকালেই নই।” হয়তো কথাটা সত্য। কিন্তু যে দর্শক অভিনয়ের এই গভীরতায় বিচার করেন, ব্রেখ্ট কি তাঁকেই নাট্যের অন্যতম ‘দর্শক-শিল্পী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন না? রুশতীর সঙ্গে আমাদেরও অভাব বোধ হয় কেন উনি সেই ভাবে বিজন ভট্টাচার্যকে মঞ্চে দেখতে পেলেন না! এই অভিজ্ঞতা নিয়ে রুশতী যখন লেখেন স্বপ্নসন্ধানী, অর্ঘ্য, নান্দীকার অথবা থিয়েট্রনের প্রযোজনা নিয়ে, তার বিষয় থেকে উপস্থাপনায় নাট্য হয়ে ওঠার ভঙ্গি নিয়ে, তখন বোঝা যায় কতটা জোর তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। এই দর্শক-লেখিকা একটি নাটক শুধু একবার দেখেছেন তা-ই নয়, প্রয়োজনে একাধিক বার দেখেছেন, লক্ষ করেছেন নাটকের পরিবর্তন, অভিনয়ের পরিবর্তন, উপস্থাপনের পরিবর্তন। তাঁর লেখায় সেই পরিবর্তনের বিকল্প শিল্পের বিশ্লেষণে এক ভিন্ন রূপ নিয়ে এসেছে। এক জন আজকের নাট্যকর্মীর কাছে যা একান্ত নির্ভর বলে মনে হবে। রুশতী ‘বাংলামঞ্চের অভিনেত্রী’র কথাও ভেবেছেন। লিখেছেন। তৃপ্তি মিত্রের দৈনিক জীবন যাপনের সঙ্গে একটি গল্প কী ভাবে লেখা হয়, অথবা ‘রাজা’ অভিনয়ের সংলাপ উচ্চারণের সেই অনুভব থেকে মায়া ঘোষ, রেবা রায়চৌধুরি, কেতকী দত্ত থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের অভিনেত্রী পর্যন্ত নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চান রুশতী। আমার মনে হয় ‘সিগাল’-এর আয়োজনে অভিনেত্রীদের নিয়ে যে আলোচনাসভা হয়েছিল এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, রুশতী সেখানে উপস্থিত থাকলে পরবর্তী পর্বে আমরা সমৃদ্ধ হতাম। কারণ, এই লেখিকাই আমাদের বাধ্য করেন ‘বিন্ধ্যবাসিনী’ তথ্যচিত্রের রূপারূপ বর্ণনা পাঠের পর আগ্রহ ভরে আর একটু জেনে নিতে। যেমন আমরা বিস্মিত হই বীণা মজুমদারের ‘অন্তঃশীলা’ উপন্যাসের সন্ধানে।
বৃদ্ধা ‘বিন্ধ্যবাসিনী’ থেকে যে বিকল্প ভাবনার উৎস, সেখানেই এসে যুক্ত হয় নবারুণ ভট্টাচার্যের আর সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটক ‘কাঙাল মালসাট’, চলচ্চিত্র ‘হারবার্ট’। যুক্ত হয় মণীন্দ্র গুপ্ত-র অন্তর্মুখী কবিতা, আফসার আমেদের গল্প, ‘মোহর-কণিকা’র গানের মগ্নতা, আন্তরিকতার আনন্দ। এঁদের সঙ্গেই মিশে থাকে বাংলা নাটকের শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র থেকে কৌশিক সেন, মনীশ মিত্র, ব্রাত্য বসু, শাশ্বতী, সুরঞ্জনা সকলে। এই ধরনের বাংলা গ্রন্থ এর আগে আমরা পাইনি, যেখানে সময়ের আধার সমকাল। এই পাঠক-দর্শক শিল্পী রুশতী আমাদের এক বিকল্প সংকলন উপহার দেন, যা সময়ের সঞ্চয়। গ্রন্থ শেষে ‘নির্দেশিকা’ খুব জরুরি। যেমন জরুরি আজকে বহু কথায় ভরা সমাজে নির্মম ভাবে শিরোনামে ‘ফালতু’ শব্দের ব্যবহার। আজকের শিল্পের পরিচয়সন্ধানী পাঠকের কাছে এ এক অপরিহার্য সংকলন। |
|
|
|
|
|