|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অনেক নেপথ্য-বৃত্তান্ত অজানাই থাকল |
অশোক মুখোপাধ্যায় |
উৎপল দত্ত / জীবন ও সৃষ্টি, অরূপ মুখোপাধ্যায়। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ৯৫.০০ |
বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধ জুড়ে বাংলা থিয়েটারের যে বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে, তার অগ্রণী স্থপতিদের মধ্যে উৎপল দত্তের স্থান খুবই উঁচুতে। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। তিনি যে এক জন যুগস্রষ্টা নাট্যপরিচালক ছিলেন এবং ছিলেন এক জন পরাক্রান্ত অভিনেতা, এ কথাও সর্বজনমান্য বলেই মনে হয়। কিন্তু উৎপল দত্তের নাট্যচিন্তা, রাজনীতি ও থিয়েটারের নিবিড় অবিভাজ্য সম্পর্কের বিষয়ে তাঁর অবিচল প্রত্যয়, সমাজ ও শিল্পের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে তাঁর মতামত, তাঁর সৃষ্ট শিল্প ও তাঁর যাপিত জীবনের মধ্যেকার মিল ও অমিল এই সব কিছু এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে গড়ে ওঠা এক বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন উৎপল। আজীবন। এবং এখনও, তাঁর মৃত্যুর পরে দুই দশক অতিক্রান্ত হতে চললেও সে বিতর্ক রয়ে গেছে সজীব ও অর্থময়।
শুধু যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন উৎপল তা-ই নয়, রেখে গেছেন সৃষ্টির বিপুল বৈভব। বহুকৌণিক ছিল তাঁর সৃজনীপ্রতিভা। নাটক লেখা ও প্রযোজনা ছাড়াও নাটকের দল তৈরি ও তাকে চলমান রাখার কাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন বহু অতীব জনপ্রিয় যাত্রাপালা। অসংখ্য পথ-নাটিকার মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর দীপ্ত মনীষার ছোঁওয়া। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই অনর্গল রচনা করেছেন কালজয়ী সব নাট্যনিবন্ধ। রচনা করেছেন নাট্যগ্রন্থ। লিখেছেন কবিতা। প্রদান করেছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেশে ও বিদেশে। অভিনয় করেছেন নাট্যমঞ্চের বাইরে বহু স্মরণীয় চলচ্চিত্রে বাংলায় ও হিন্দিতে। নির্মাণ করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র। বহু বার গিয়েছেন বিদেশ ভ্রমণে। নাট্যাচার্যের মতোই তৈরি করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীর বাহিনী, প্রজন্মের পর প্রজন্মে। চালিয়েছেন নাটমঞ্চ এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে। মতাদর্শগত সংগ্রামের ফলস্বরূপ কারাবরণ করেছেন এমনকি। এত বিশাল এবং একই সঙ্গে এত বিচিত্র, জটিল, বহুবর্ণ চরিত্র দুশো বছরের বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
উৎপল দত্তের জীবন ও সৃষ্টির একটি নির্ভরযোগ্য আখ্যান থিয়েটারের ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কোনও সন্দেহ নেই, এ কাজ আদৌ সহজসাধ্য নয়। আমাদের সৌভাগ্য, প্রভূত পরিশ্রম ও দীর্ঘকালীন তন্নিষ্ঠ গবেষণায় উৎপলীয় জীবন-বৃত্তান্ত রচনায় সফল হয়েছেন অরূপ মুখোপাধ্যায়। উৎপল দত্ত/ জীবন ও সৃষ্টি শীর্ষক তাঁর গ্রন্থটি নাট্যস্রষ্টাদের জীবনীগ্রন্থের তালিকায় উল্লেখযোগ্য স্থান পাবে নিঃসন্দেহে। উৎপলের জীবন ও তাঁর সৃষ্টিকর্মকে যুগপৎ এক দ্বৈত ভঙ্গিতে দেখতে চেয়েছেন অরূপ। এক দিকে যেমন সাল-তারিখের বিন্যাসে কালানুক্রম তৈরি করেছেন, তেমনই আবার সৃষ্টির বিষয় ও আঙ্গিকের বিশ্লেষণ করে চলেছেন সঙ্গে সঙ্গে। এর ফলে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে উৎপলের বেঁচে থাকাকে বুঝে নিতে যেমন সাহায্য হয়েছে, তেমনই স্রষ্টা উৎপলের অন্তর্ভুবনের নানা সংকট ও বিবর্তনের এক বিশ্বস্ত কমেন্টারি রচনা করা গিয়েছে।
প্রায় তিনশো পাতার এই জীবনী-আলেখ্য বারোটি সুপরিকল্পিত পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম দু’টি পর্বে উৎপলের ছোটবেলা, পারিবারিক পটভূমি ও নানা বিরোধী স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বালকের সৃষ্টিসত্তার জাগরণ সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে। স্কুল ও কলেজে, বিশেষ করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় তাঁর নাট্যক্ষমতার বিকাশের পটভূমিটিও স্পষ্ট। এর পর উৎপল দত্তের জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে গুরুত্বলাভ ঘটে। ইংরেজ নাট্যব্যক্তিত্ব জেফ্রি কেন্ডালের পেশাদার নাট্যশালায় দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে পরবর্তী জীবনের পেশাদার নাট্যকর্মী উৎপলের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার কাহিনিও তথ্যপ্রমাণ সহযোগে বিবৃত হয়েছে। এর পর লিটল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা উৎপল দত্তের গোত্রান্তর ঘটে। মার্ক্সবাদী জীবনবীক্ষায় তাঁর আস্থা দৃঢ়তর হতে থাকে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ছত্রছায়ায় থিয়েটার করার স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার পরে তিনি ফিরে আসেন নিজের দলের সৃজনী-বৃত্তে। কিন্তু ‘জনতার মুখরিত সখ্য’ থেকে আর দূরে থাকেননি কখনও। ইংরেজি পেশাদার থিয়েটারের কঠোর শৃঙ্খলার সঙ্গে এ বার যোগ হয় রাজনৈতিক থিয়েটার গড়ে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। পথ-নাটকের সৃষ্টি ও প্রযোজনার সঙ্গে সঙ্গে পেশাদারি ভিত্তিতে মিনার্ভা রঙ্গালয় চালানোর দুরূহ নিরীক্ষায় নিযুক্ত হন উৎপল ও তাঁর দল এল টি জি।
তত দিনে সত্তর দশকের উত্তাল সময় এসে পড়েছে। নকশালপন্থী রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ থেকে তৈরি নাটক ‘তীর’ উৎপলকে সংকটের সীমায় নিয়ে যায়। বামপন্থার মূল ধারার সঙ্গে সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়তে হয় উৎপলকে। উপর্যুপরি গ্রেফতার, কারাবাস ও রাজনৈতিক তৎপরতায় উৎপলের জীবন এই সময়-পর্বে বিক্ষুব্ধ, টালমাটাল। এর পর অক্লান্ত উৎপল গড়ে তোলেন নতুন নাট্যসংস্থা পিপলস লিটল থিয়েটার। এক আধুনিকতর নাট্য-ব্যক্তিত্বের অভ্যুদয় লক্ষ করি আমরা। রাজনৈতিক যাত্রাপালা রচনা ও প্রযোজনায় নতুন ঘরানা সৃষ্টি করেন এই পর্বেই। চলচ্চিত্রের অনন্য অভিনেতা হিসেবেও এই দ্বিতীয় পর্বে উৎপলের প্রতিষ্ঠালাভ ঘটে। আশির দশকের শেষ দিক থেকেই অসুস্থ হতে শুরু করেন উৎপল। অবশেষে ১৯৯৩ সালে ব্যাধিজর্জর কিন্তু তখনও অক্লান্ত স্রষ্টা এই মানুষটির প্রয়াণ ঘটে।
উৎপল দত্তের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের বিশ্বস্ত তথ্যনির্ভর আলেখ্য রচনা করে অরূপ মুখোপাধ্যায় আমাদের মতো নাট্যজনদের এবং নাট্যোৎসাহী বাঙালি পাঠক মাত্রেরই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদভাজন হয়েছেন। কিন্তু তাঁর গ্রন্থের বিশিষ্ট মূল্য এখানেই যে, তিনি উৎপল-মানসেরও একটি অনুসন্ধান গোটা গ্রন্থ জুড়ে জারি রেখেছেন। উৎপলের যেমন ছিল বহুমুখী সৃজনশক্তি, তেমনই ছিল দিকপাল পাণ্ডিত্য। থিয়েটারের মঞ্চে তিনি যেমন ইতিহাস ও রাজনীতির বিশ্লেষণ হাজির করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্যে, তেমনই সারা জীবন ধরে আলোচনা, প্রত্যালোচনা, তর্ক-বিতর্কে যেন সৃষ্টি করে গেছেন এক গ্র্যান্ড ডিসকোর্স-এর। বাংলা থিয়েটারের বৌদ্ধিক মেরুদণ্ড তৈরিতে তাঁর থেকে দক্ষ কারিগর কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু থিয়েটার ও রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব ও সঙ্গমের মধ্যে থেকে মাঝেমধ্যেই তৈরি হয়েছে নানা স্ববিরোধ উৎপলের জীবনে ও সৃষ্টিতে। যেমন, সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ক্ষমতাসীন বামপন্থার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব, আবার অল্প দিন পরেই বামবৃত্তের চেনা ছকে তাঁর প্রত্যাবর্তন, এর মধ্যে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছে। মিনার্ভা থিয়েটার তাঁকে কেন ছাড়তে হয়েছিল, তারও সম্পূর্ণ নেপথ্য-বৃত্তান্ত এখনও অনুদ্ঘাটিত। এক জন সফল পেশাদার অভিনেতার সচ্ছল জীবনযাত্রার সঙ্গে শোষণমুক্তির জেহাদি থিয়েটারের ডাক সব সময়ে মেলানো গিয়েছে কি? এই সব বিতর্ক থেকে চোখ সরিয়ে রাখা ভবিষ্যৎ থিয়েটারের স্বার্থে ঠিক হবে না। আলোচ্য গ্রন্থে এই রকম কিছু প্রশ্ন ও প্রসঙ্গের সাবলীল বিশ্লেষণ পাওয়া যায় না। ভাষা-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আর একটু নৈর্ব্যক্তিকতা এ ধরনের গবেষণাধর্মী গ্রন্থের পক্ষে মানানসই হত। তবু, এ বইয়ের জন্য নিঃসন্দেহে গ্রন্থকার অরূপ মুখোপাধ্যায় ও প্রকাশক ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া-র পাওনা হয়েছে বাঙালি নাট্যজনের আন্তরিক অভিনন্দন। |
|
|
|
|
|