|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা ১... |
|
জীবনের উঠোনে লাল-সবুজ মুখোমুখি |
স্বপ্নসন্ধানীর নতুন নাটক। কিন্তু নাটকের বাইরে আসলে তো পরিচালক
কৌশিক সেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। লিখছেন তাপস সিংহ |
পরিবর্তনের সেই মুহূর্তও এত দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের জন্ম দিল!
লাল পতাকা হাতে শহরের পথে চরম বিভ্রান্ত এক তরুণ। শহিদ বেদি থেকে খুলে নেওয়া বহু বছরের আশ্রয় সেই লাল পতাকা সে কোথায়, কার আশ্রয়ে রাখবে? কোথায় যাবে সে? তার চার পাশে তত ক্ষণে ভিড় করেছে অনেক রঙিন ছাতা লাল, সাদা, সবুজ, নীল...যেন পাল্টে গিয়েছে আশ্রয়ের সংজ্ঞা। টেলিভিশন চ্যানেলে ঘোষকের উত্তেজিত গলা শোনা যায়: যাদবপুর কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মণীশ গুপ্তের থেকে পিছিয়ে আছেন ২৮৭৬ ভোটে! নিরুপম সেন পিছিয়ে পাঁচ হাজার ভোটে! গৌতম দেব, ঘুরে দাঁড়ানোর মুখ, পিছিয়ে ৪৯৯২ ভোটে!...একের পর এক মহীরুহের পতন!
এটা প্রেক্ষাপট। মঞ্চের নাট্যের সঙ্গে যেখানে মিশে যায় ঘোর বাস্তবের চিত্রনাট্য! ১৩ মে, ২০১১। বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর্ব চলছে সেই মুহূর্তে। পাল্টে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্যানভাস। উদ্ভব হচ্ছে এক বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির। ৩৪ বছর পরে! আর সেই প্রেক্ষাপটে তৈরি হচ্ছে আর এক নাট্যের। পরতে পরতে খুলতে থাকছে চিরচেনা জীবনযাপনের এক্কেবারে অচেনা অধ্যায়!
শ্মশানের চুল্লিতে পুড়ে ছাই হচ্ছে সুমৌলি সেনের দেহ। আর শ্মশানের পাশের চায়ের দোকানে মুখোমুখি তাঁর জীবনের দুই পুরুষ এক জন তাঁর স্বামী শৌনক সেন, আর এক জন তাঁর প্রেমিক প্লাবন সরকার!
এই শহরের সুমৌলি আত্মহত্যা করেন ১২ মে, ২০১১-র রাত্রিবেলায়। পরের দিন, ১৩ মে এ শহরের শ্মশানে সুমৌলির দেহটা চুল্লিতে ঢোকানোর কয়েক মুহূর্ত আগে শৌনক আবিষ্কার করলেন, তাঁর স্ত্রীর এক প্রেমিক ছিল! প্রেমিক! যে স্ত্রী তাঁর ট্যুরের ব্যাগ গুছিয়ে দিত নিজের হাতে, যাবতীয় স্ত্রী আচার করে যেত মুখ বুজে, তার নাকি এক প্রেমিক আছে! যে প্রেমিক ফুল হাতে তাঁর স্ত্রীর দেহের সামনে নতজানু হয়!
জীবনের বাঁকে বাঁকে এত অজানা প্রশ্নপত্র লুকিয়ে থাকে! এমন প্রশ্ন, যার উত্তর খোঁজাটা বড়ই মুশকিল! ‘স্বপ্নসন্ধানী’র নবতম প্রযোজনা ‘সেই সুমৌলি’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিল। জ্বলন্ত চুল্লিতে এক নারীর দেহ সাক্ষী রেখে দুই পুরুষের উচ্চারিত সংলাপের সঙ্গেই পরতে পরতে উচ্চারিত হয় গভীর জীবনবোধের সংলাপও। ইন্দ্রাশিস লাহিড়ীর লেখা সেই নাটকের আধারে নির্দেশক কৌশিক সেন মিলিয়ে দিয়েছেন সাম্প্রতিক রাজনীতিকে।
ঘটনাচক্রে দিনটি ১৩ মে। রাজ্য বা জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দিনটি ইতিমধ্যেই ইতিহাসে ঢুকে পড়েছে। শ্মশানের বাইরে তখন জয়োন্মত্ত তৃণমূল সমর্থকদের নাচ আর উল্লাস। হাওয়ায় উড়ো চিঠির মতো ভেসে যাচ্ছে সবুজ আবির। আর তার মধ্যেই শ্মশানের পাশের শহিদ বেদির মাথায় পতপত করে ওড়া লাল পতাকা নামিয়ে আনছেন দুই সিপিএম সমর্থক।
ঘোর প্রতীকী! |
|
শৌনক: নারী-পুরুষের গভীর সম্পর্কে একটা ইয়ে লাগে...একটা লিগাল স্যাংশন।
প্লাবন: তার মানে সম্পর্কটা লিগাল স্যাংশন পেলেই গভীর?
শৌনক: নিশ্চয়।
প্লাবন: তা হলে আপনাদের সম্পর্কটা গভীর হল না কেন?
জীবন-সংলাপ এগিয়ে চলে। আছড়ে পড়তে থাকে উৎসবের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস।
প্লাবন: আচ্ছা, সুমৌলি যে কবিতা লিখত, সেটা কি আপনি জানতেন?
শৌনক: না তো। সেই ভাবে নিয়মিত লিখত বলে তো জানতাম না।
প্লাবন: আমরা একটা ছাদের তলায় থাকি, ছাদটা আজ আমার জন্য কাঁদে/আমরা একটা ছাদের তলায় থাকি, ছাদটা আজ তোমার জন্য কাঁদে/কারণ আমরা ছাদ নির্ভর, ছাদ আমাদের বাঁধে/ছাদ আমাদের বাঁধে আবার ছাদই কিন্তু জানে/এই ভাবে টিকে থাকার নেই তো কোনও মানে।
নাট্যকার ইন্দ্রাশিসের নিজেরই কবিতা আউড়ে গেছে সুমৌলির প্রেমিক প্লাবন। কিন্তু, এক নারীর আত্মহত্যার পরে তার সঙ্গে সম্পর্ককে ঘিরে দু’টি পুরুষের এই টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনীতি কী ভাবে আসে? মূল নাটকে যেখানে রাজনীতি নেই? নির্দেশক কৌশিক সেন বলছেন: “সুমৌলিকে দুই পুরুষ দু’ভাবে দেখে। এক জন নিছক ব্যবহারিক জীবন থেকে, আর এক জন তার মনন ও বুদ্ধিবৃত্তি থেকে। তার ফাঁকে সুমৌলি চলে গেল। আমার মনে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বাম শাসনকেও সে ভাবেই দেখা হয়েছে স্রেফ ব্যবহারিক জীবন ও তাত্ত্বিক দিক থেকে। এখন যখন রাজ্যে সিপিএম নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে, তখন প্রচার হচ্ছে, যেন বামপন্থারই পতন হয়েছে। কিন্তু, সেটা কি ঠিক ভাবনা?” ‘স্বপ্নসন্ধানী’র এর আগের প্রযোজনা ‘বীরপুরুষ’-এও তো একই ভাবে এসেছিল রাজনীতি! জঙ্গলমহলের রাজনীতি। মাওবাদীদের আনাগোনা। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার অনুপ্রেরণায় রচিত হয়েছিল ওই নাটক। শুধু ওইটুকুই। বাকি নাটক স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছে সমসাময়িক এক আগুনে সমস্যার অন্দরে। এ বারের প্রযোজনাও ব্যতিক্রম নয়।
অনবদ্য অভিনয়ে মাতিয়ে দিয়েছেন এই প্রযোজনার মুখ্য দুই অভিনেতা, সুমৌলির স্বামীর ভূমিকায় রজতাভ দত্ত ও তার প্রেমিকের ভূমিকায় দেবদূত ঘোষ। বহু গভীর মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন এই দুই অভিনেতা। রজতাভ দীর্ঘ দিনের মঞ্চাভিনেতা। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের এই দুই সুপরিচিত মুখকে নিপুণ ভাবে ব্যবহার করেছেন কৌশিক। গৌতম ঘোষের আবহ চমৎকার। নাটকের মূল মেজাজকে ছুঁয়ে ফেলেছে সঞ্চয়ন ঘোষের ভাবনায় পার্থ মজুমদারের মঞ্চনির্মাণ। অঞ্জন দত্তের সেই গান ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’র ব্যবহার অনবদ্য। এই নাটকের জন্য অঞ্জন নতুন করে গেয়েছেন গানটি।
দু’টি পুরুষের সংলাপ ছাপিয়ে নাটকটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পেরেছে ‘স্বপ্নসন্ধানী’। ১৩ মে দিনটিকে অসাধারণ ভাবে ব্যবহার করে।
ছেলেবেলার গল্প বলছিলেন কৌশিক। ছেলেবেলায় হরিশ মুখার্জি রোডের মাঠে ফুটবল খেলার সময় ফাউল করা নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কির সময় স্থানীয় এক কংগ্রেস সমর্থক কৌশিককে বলেছিলেন, ‘‘তুই আবার কথা বলিস কী! তোর বাবা-মা তো ‘বস্তিপার্টি’ করে!’’ সেটা ’৭৭। বামফ্রন্ট সদ্য ক্ষমতায় এসেছে। ছোট্ট কৌশিককে তার বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘বস্তিপার্টি’ মানে সিপিএম। সিপিএম আসলে গরিবের পার্টি। লাল পতাকা আসলে আশ্রয়! সেই বোধ নিয়েই বড় হয়েছেন কৌশিক, যত দিন না তাঁর সেই অনুভূতি প্রবল ধাক্কা খেয়েছে।
রঙিন ছাতা লাল পতাকার পথ আটকায়। বিভ্রান্ত যুবক শহরের পথে সেই পতাকা হাতে আশ্রয় খোঁজে। সে হাত থেকে সেই পতাকা ফেলতেও পারছে না! যে পতাকা তার কাছে এত দিন ছিল আশ্রয়ের প্রতীক, সেই পতাকাকে কোথায় আশ্রয় দেবে সে? আর সেই রঙিন ছাতার ঝাঁকের আড়াল থেকে যে ক্ষমতা উঁকি মারে?
কৌশিক বলছেন, ‘রাজ্যে এটা অজানা শক্তি। এই ক্ষমতা শেষমেশ জনগণের সঙ্গে কী ব্যবহার করবে তা আমরা এখনও জানি না।’
সুমৌলির থাকা আর না-থাকার মাঝে কী বিরাট এক পরিবর্তন দুই পুরুষের জীবনে! সুমৌলির থাকা আর না-থাকার মাঝে কী বিরাট পরিবর্তন এই রাজ্যেও!
পরিবর্তনের সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণও এত দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়! |
|
|
|
|
|