|
|
|
|
|
|
...দুর্গার বশে |
প্রবাসে পুজোর মজা |
অমৃতা চৌধুরী |
এত দিন যে ভাবে পুজো কাটিয়ে এসেছি, তার চেয়ে অনেকটাই অন্য রকম এ বছরটা। পুজো শুরুর অনেক আগে থেকে পুজোর বাজার নেই। চার দিক ঝলমল করা আলোর বাহার নেই। বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করে পুজো দেখার মজা নেই। পাড়ায় পাড়ায় সেই ভোরবেলা থেকে মাইকে গান নেই। শুনেছিলাম বিদেশে নাকি ঘরোয়া পরিবেশে পুজোগুলো বেশ জমজমাট হয়। কিছুটা হলেও কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি, অসমে বাপের বাড়ির পুজো ছেড়ে এ বারই আমার সানফ্রান্সিসকোর বে-এরিয়ায় প্রথম পুজো।
সবচেয়ে অন্য রকম ব্যাপার হল কলকাতায় যখন সবে ষষ্ঠী, এখানে এক দফা পুজো হয়ে গিয়েছে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী সব। ফেসবুক-অর্কুটে সে সব ছবিও অনেকেই আপলোড করে ফেলেছে কলকাতার বন্ধুদের ঢের আগে। আগে প্রবাসী আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের কাছে গল্প শুনতাম বিদেশে পুজোর কাছাকাছি উইকএন্ডে উদ্যাপন সেরে ফেলার কথা। আসলে এখানে তো আর পুজোর দিনগুলোয় কারও ছুটি থাকে না। তাই সবার সুবিধামতো, পুরোহিতের বিধান মেনে সপ্তাহান্তেই পুজো কাটান এখানকার বাঙালিরা।
|
|
আমেরিকার অন্যান্য জায়গার মতো ক্যালিফোর্নিয়াতেও ছোট-বড় অনেকগুলো পুজো হয়। সানফ্রান্সিসকোর বে-এরিয়ায় যেমন উল্লেখযোগ্য পুজোগুলো হল ‘পশ্চিমি’, ‘বে-বাসী’, ‘সংস্কৃতি’, ‘প্রবাসী’ ও ‘উৎসব’। এ বছরও অক্টোবরের ১ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত কোথাও উইকএন্ডে, কোথাও তিথি মেনে পুজো করেছে সবক’টা সংগঠন। পুজোর যাবতীয় আমেজ হইচই, আনন্দ, জমাটি খাওয়াদাওয়া, সবাই মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, কিছুই বাদ নেই। প্রত্যেকটা পুজোই অবশ্য নিজের মতো করে নজরকাড়া। ‘উৎসব’ যেমন এ বার ১০ বছর পেরোলো। তাদের এ বারের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কলকাতার অনীক ও অন্বেষার গান এবং তনুশ্রীশঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠান। ‘পশ্চিমি’ আবার বড় ও ছোটদের নাচ-গান, আবৃত্তি ছাড়াও রেখেছিল হাস্যকৌতুক, শ্রুতিনাটক এবং ব্যান্ডের গান। পিছিয়ে নেই ‘বে বাসী’র পুজোও। তাদের উদ্যাপন শুরু হয় ডান্ডিয়া নাচে। এক ছাদের নীচে গানের সিডি, পুজোসংখ্যা আর জিভে জল আনা খাবারের বিকিকিনি। এমনকী লক্ষ্মীপুজো ও বিজয়া সম্মিলনীর দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলেছেন ওখানকার উদ্যোক্তারা। নির্ধারিত দিনে, ১ অক্টোবর শুরু হল ‘সংস্কৃতি’র পুজো। ক্যালিফোর্নিয়ার মিলপিটাসে ১৯৯৮ সালে বার্ষিক অনুষ্ঠান ও পুজো দিয়ে তাদের চলা শুরু। এ বছর বিদেশে এসে আমার প্রথম পুজোর অভিজ্ঞতা ওদের ওখানেই, ফ্রেমন্ট সেন্টারভিল জুনিয়র হাইস্কুলের অডিটোরিয়ামে।
বাঙালিরাই নন, সমান উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এই পুজোটায় মেতেছেন বহু অবাঙালিও। স্কুলের ইন্ডোর বাস্কেট বল কোর্টটাই দু’দিনের জন্য আমূল বদলে গিয়ে ঝলমলে পুজোমণ্ডপ। সবচেয়ে ভাল লাগল মায়ের সেই ছোট একচালা প্রতিমা, একদম বাড়ির পুজোর মতো। খুব যত্ন করে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র পাঠ করালেন পুরোহিতমশাই। আর হ্যাঁ, ডিজিটাল ঢাকের বাদ্যি নয়। আসল ঢাকিরা ছিল।
সন্ধ্যারতি, পুষ্পাঞ্জলি থেকে ভোগ খাওয়া, ফাস্ট ফুডের স্টল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে ইন্ডোর গেম্স প্রতিযোগিতা বাদ পড়েনি কিছু। পুজোর আনন্দের মধ্যে যাঁরা দেশি পোশাক আর গয়না কিনে রাখতে চান, হতাশ হননি তাঁরাও। মণ্ডপেই ছিল ভারতীয় পোশাক-গয়নার দোকান। পুজোর ভোগ খেতে এসেছিলেন আমেরিকানরাও। খুব স্বচ্ছন্দে সালোয়ার-কামিজ পরে আমাদের সঙ্গেই লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগ খেয়ে গেলেন বিদেশিনীরা। ভিন্ন ভাষা-ধর্মের মানুষদের এতটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের উৎসবে অংশ নিতে দেখে খুব ভাল লাগছিল। |
|
দু’দিনে ‘সংস্কৃতি’ আমার প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে ‘পশ্চিমি’র পুজো। তিথি মেনে অক্টোবরের ২ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত ওদের পুজো। এ বারই প্রথম তা হল ফ্রেমন্ট-এর হিন্দু মন্দিরে। আর প্রতিমা? খাস কলকাতার কুমোরটুলি থেকে।
এখানকার পুজো দেখতে ভিড়টা ছিল চোখে পড়ার মতো। মনে হচ্ছিল যেন আমেরিকায় নয়, বাংলাতেই কোথাও রয়েছি। অষ্টমীতে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ বা ঝিরঝিরে বৃষ্টিও মোটেই দমাতে পারেনি। অনেক দূরের শহর থেকেও দলে দলে পৌঁছে গিয়েছেন অদম্য বাঙালি। আর সেটাই যেন অঞ্জলি বা প্রসাদ খাওয়ার আনন্দটাকে দ্বিগুণ করে দিল। দশমীতে বরণ ও সিঁদুরখেলায় শেষ হল পুজো। একই মূর্তিতেই যেহেতু পরের বছর পুজো হবে, তাই সিঁদুর পরানো হল শুধু ঘটে আর ছোট তামার প্রতিমায়। মায়ের বিসর্জন না হওয়াটাও কিন্তু বেশ অন্য রকম একটা অনুভূতি।
তৃতীয় রাউন্ডে পুজো ‘বে-এরিয়া প্রবাসী’র, অক্টোবরের ৮ আর ৯ তারিখে। এখানকার একটা কলেজের মাঠে বিশাল জায়গা জুড়ে পুজোর ব্যবস্থা। ১৯৭৪ থেকে শুরু হওয়া এই পুজোটায় দেখলাম সত্যি সত্যিই বেশ কলকাতার মতো ভিড়। সন্ধ্যা আরতিতে ধুনুচি নাচে সব মেয়ে-বৌরা হাতে হাত মিলিয়ে নাচলেন। খাবারদাবার, শাড়ি-গয়নার অস্থায়ী দোকানগুলোতে থিকথিক করছে লোক। ঠিক আমাদের কলকাতার মেলার মতোই তো!
তিন পর্বে এ ভাবে পুজো তো আগে কখনও কাটাইনি। পুজোয় বাড়ি থেকে দূরে, আপনজনদের থেকে দূরে থাকার একটা কষ্ট ছিলই। তার উপরে প্রথম বার বিদেশে। পুজোটা কেমন কাটবে, কতটা আশা করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। তবে প্রথম উইকএন্ডের পুজোর অভিজ্ঞতা সেই সংশয় অনেকটাই কাটিয়ে দিল। আমার মতোই যাঁরা বাড়ি থেকে দূরে, এমন কয়েক জন নতুন বন্ধুর সঙ্গে আলাপও হল। বিভিন্ন সংগঠন দলবেঁধে সুন্দর ভাবে আয়োজন করায় কলকাতা থেকে এত দূরে বসেও বেশ আনন্দেই কাটল প্রবাসে আমার প্রথম পুজো।
আসছে বছর আবার হবে! |
|
|
|
|
|