পুর-উদ্যোগ
নির্মাণের পথে তথ্য-ভাঁড়ার
লমারিতে ডাঁই করে রাখা বইতে হাত দিলেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে পাতা। বইগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ যে সেগুলি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। বই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এই সব বই পাঠকদের ব্যবহারের জন্য অনুমতিও দিতে পারছেন না পুর-কর্তৃপক্ষ। এই অবস্থাতেই দিনের পর দিন পড়ে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য সব পুর-নথি।
কলকাতা পুরসভার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই দুষ্প্রাপ্য নথিগুলিকে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য পুর-কর্তৃপক্ষ আধুনিকমানের একটি আর্কাইভ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুরনো কলকাতার নানা তথ্য সম্বলিত এই বইগুলি যদি সঠিক ভাবে সংরক্ষিত হয়, গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কাজ হবে। সেই সময়কার শহরের পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত অনেক অজানা তথ্যও জানতে পারব। ফলে আমাদের কাজেরও সুবিধা হবে। সেই কারণেই পুরসভার এই সব তথ্য ধরে রাখার জন্য আর্কাইভ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী এপ্রিলের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করেছি।”
১৯২৪ সাল থেকে প্রকাশিত ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটে পুরসভা সংক্রান্ত যে সমস্ত তথ্য বেরিয়েছে তা এই আর্কাইভে রাখা থাকবে।
পুরসভার তথ্য ও জনসংযোগ দফতর সূত্রে জানা যায়, ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট’-এ কলকাতা পুরসভা নিয়ন্ত্রিত শহরের প্রধান সাতটি বাজারের সাপ্তাহিক বাজার দর লেখা হত। এই বাজার দরের মধ্যে প্রধানত সব্জি, ফল, ডিম, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে পেট্রোল ও কেরোসিনের মূল্যও লেখা থাকত। পুরসভার তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের আধিকারিক অরুণ রায় বলেন, “পুরসভার তথ্য থেকেই জানতে পারা যায়, প্রতি শনিবার এই কাগজ প্রকাশিত হত। ১৯২৪ সালে সুভাষচন্দ্র বসু পুরসভার মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার থাকার সময়েই কাগজটিতে বাজারদর ছাড়াও পুর-পরিষেবা এবং শহরের নানা খবর পরিবেশন করা হত। ১৯২৪-এর নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এই কাগজ বের হত। তার পর থেকে অনিয়মিত হলেও ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই কাগজ বার করা সম্ভব হয়েছিল। তার পর এই প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।” অরুণবাবু জানান, প্রকাশিত মিউনিসিপ্যাল গেজেটের সংখ্যাগুলি প্রায় সবই বাঁধাই করে রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া, কলকাতা বিষয়ক বেশ কিছু পুরনো বইও পুরসভায় রয়েছে। সব ক’টির অবস্থাই খারাপ। পাতাগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ যে এই তথ্য থেকে গবেষকেরা কোনও কাজ করতে পারছেন না। বর্তমানে কিছু বই টাউন হলের লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
পুরকর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই গেজেটে বাজারদর ছাড়াও আরও যে সমস্ত তথ্য প্রকাশ পেতে শুরু করল সেগুলি হল, রাস্তার নামকরণ সম্বন্ধীয় নোটিস, অসংখ্য চিঠিপত্র, প্রচারপত্র এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিবরণ।
পরে, এই গেজেটে কলকাতা পুরসভার অধিবেশনের বর্ণনা, বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা, অসংখ্য আলোকচিত্র-সহ মূর্তি, পার্ক, রাস্তার ছবি-সহ অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন পুরসভার কার্যাবলী ছাপা হতে লাগল। এমনকী, ইউরোপের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরের পুর-পরিষেবার সঙ্গে কলকাতার পুর-পরিষেবার তুলনামূলক আলোচনাও পুরসভার এই গেজেটে ছাপা হত।
অরুণবাবু বলেন, “বর্তমানে এই পত্রিকাগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে এসেছে যে সাবধানে পাতা না ওল্টালে পাতা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এখানে-ওখানে পড়ে থাকা নানা তথ্য যোগাড় করে অনেক কষ্টে সেগুলিকে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। কিছু বই অবশ্য ইতিমধ্যেই টাউন হলে পুরসভার লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে। বর্তমানে যেখানে পুরসভার তথ্য ও জনসংযোগ দফতর রয়েছে সেখানেই এই আর্কাইভ থাকবে।”
এই আর্কাইভে কী কী থাকবে?
পুরসভা প্রাথমিক ভাবে আর্কাইভের যে সমীক্ষা করেছে তাতে আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়াও, বিভিন্ন মূর্তি, কলকাতা বিষয়ক নানা লেখা, পুরসভার নাগরিক সংবর্ধনা এবং টাউন হলের ইতিহাস ছাড়াও শহরের বিশিষ্ট মানুষদের ছবি-সহ সংক্ষিপ্ত জীবনী সিডি করে আর্কাইভে রাখা থাকবে। আর্কাইভে প্রতিটি বিষয়েই আলাদা আলাদা ঘর থাকবে।
পুরসভার কান্ট্রি এবং টাউন প্ল্যানিংয়ের ডিরেক্টর জেনারেল দীপঙ্কর সিংহ বলেন, “আর্কাইভ না করলে এই দুষ্প্রাপ্য তথ্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। সমস্ত প্রকল্পটি রূপায়ণ করতে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা খরচ হবে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। বর্তমানে মিউনিসিপ্যাল গেজেট ছাড়াও পুরসভার কিছু পুরনো বই টাউন হলের লাইব্রেরিতে রাখা আছে। সেগুলিকেও আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে।”

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.