|
ব্যাগ গুছিয়ে... |
দেখো তো
চিনতে পারো... |
|
উত্তরে দিগন্ত জুড়ে বিরাজমান কালচে মেঘের ওড়না জড়ানো
সপারিষদ চোমো লহরি। ঘুরে এলেন প্রসেনজিৎ পোদ্দার |
নদীর অববাহিকায় উন্মুক্ত বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বিস্তৃত চাষের জমি আর প্রান্তর পেরিয়ে দূরের পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে ও পাহাড়ের গা বেয়ে রঙিন ঘরবাড়ির সমাবেশে ধরা দিচ্ছে যে উপত্যকা, সে কি পারো? না কি শিল্পীর কল্পনায়, তুলির টানে ফুটে ওঠা কোনও জীবন্ত ছবি? নির্বাক মুগ্ধতায় ছবি তোলার কথাও ভুলে যাই। ফলে সন্ধের ‘পারো’-কে দেখে প্রথম দর্শনেই ‘দেবদাস’ হয়ে যেতে সময় লাগল না! ওয়াংদি-পুনাখা ঘুরে আমরা এখন পারোয়। ভুটানের সবচেয়ে সুন্দর শহর। উচ্চতা ৭২৩৮ ফুট।
চুজোমে পৌঁছে ওয়াংচুর ওপর সেতু পেরিয়ে পারোর পথ ধরতেই ডান দিকে খরস্রোতা নদী পা-চুকে সঙ্গী হিসাবে পেলাম। পারোর নদী বলে অনেকেই একে ‘পারো-চু’ বলে থাকেন।
আরও এগোতেই মুখোমুখি পারো বিমানবন্দরের প্রবেশপথ। বিমানবন্দরের সীমানা ঘেঁষেই পারো শহরে যাওয়ার রাস্তা চলেছে রানওয়ের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালে। আর সেই রাস্তাকে প্রায় চুম্বন করে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে পা-চু। নদী, সড়কপথ আর বিমানের রানওয়ের পাশাপাশি এমন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যেমন বিরল, তেমনই সৌন্দর্য-বুভুক্ষু চোখের পক্ষেও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক সে দৃশ্য। |
|
হোটেলও পেয়ে গেলাম প্রায় পা-চু’র গা ঘেঁষে। মাঝে শুধু গার্ডওয়াল মিটার পঞ্চাশেক দূরত্বে। সারা রাত শুধু পা-চু’র অবিরাম কলতান। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই ক্যামেরা নিয়ে দে-দৌড় গার্ডওয়ালের উপর তৈরি পায়ে চলার রাস্তায়। দেখলাম ঘুমন্ত পারোর অনবদ্য সৌন্দর্য। নির্মেঘ সুনীল আকাশের নীচে মাউন্ট চোমো লহরির (৭৩০০ মিটার) বরফগলা জলে পুষ্ট গতিশীল অনিন্দ্যসুন্দর পা-চু। তার পিছনে স্নিগ্ধ শ্যামল উপত্যকা জুড়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘরবাড়ি, আপেলবাগিচা। আরও পিছনে পারোর উত্তরে দিগন্ত জুড়ে কালচে মেঘের ওড়না জড়ানো সপারিষদ চোমো লহরি।
আর ডান দিকে ঘন সবুজ পাহাড়ের কোলে দৃশ্যমান পারো-জং ও তারও উপরে পারো মিউজিয়াম। মন ভরে গেল।
ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল সাড়ে ৯টায় রওনা হলাম ৬৮ কিলোমিটার দূরের হা-র উদ্দেশে। পথে পেরোতে হবে ৩৯৮৮ মিটার উঁচু পাস চেলো-লা। বোন্দিয়ে থেকে ডাইনে ঘুরেই পাহাড়ে চড়া শুরু। এক একটা বাঁকের সঙ্গেই পথের উচ্চতা বাড়ছে। নীচে পারোর বুক-চেরা সুদীর্ঘ রানওয়ে এখন দিব্যি ক্যামেরার লেন্সের আওতায়।
৭-৮ কিলোমিটার যাওয়ার পরই পথের দু’ধারে রডোডেনড্রনের আবির্ভাব। প্রথমে খানিকটা বিক্ষিপ্ত ভাবে। খানিক পরেই শুরু হয় লাল, গোলাপি, সাদা, হলুদ রঙের বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেনড্রনের রাজত্ব। উঁচু উঁচু গাছের ছায়াঘেরা মনোরম পথের পাশে কোথাও ছোট ছোট লালচে সবুজ আপেলবাগান। কোথাও ঘন সন্নিবদ্ধ পাইনের সারি তো কোথাও সবুজ ঘাসের বুকে বেগুনি রঙের ছোট ছোট প্রিমুলা জাতীয় ফুল। |
|
চড়াইয়ের সঙ্গে ঠান্ডার প্রকোপ ক্রমশই বাড়ছে। রাস্তার দু’পাশে রংবেরঙের অসংখ্য বৌদ্ধ-পতাকাযুক্ত এক জায়গায় গাড়ি থামতেই চোখে পড়ল একটি প্রস্তরফলক। তাতে লেখা: ‘চেলে-লা, ৩৯৮৮ মিটার’। পারো থেকে দূরত্ব ৪২ কিমি।
উচ্চতার আধিক্যের জন্য সাদা মেঘের জটলা চেলে-লা’তে। সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। ডান দিকের উঁচু জমিতে একটি চোর্তেন, আর সোজাসুজি বহু দূরে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে মেঘের প্রাচীর ভেদ করে জেগে-ওঠা তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণি।
চেলে-লা’র পর হা পর্যন্ত পথ একটানা উতরাই। কয়েক কিমি নেমে আসতেই আকাশে আবার রোদের ঝিলিক। হা পৌঁছনোর ৫-৬ কিমি আগে থেকেই দেখা দিতে শুরু করে পাহাড়ের পাদদেশে পা-চু নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা অসম্ভব সুন্দর হা উপত্যকা। নদীর দু’পারেই হা-র বিস্তার। পাখির চোখে দেখা হা-উপত্যকা যেন নিখুঁত পিকচার-পোস্টকার্ড!
আমরা এসে নামলাম হা-শহরের হাতে গোনা ২-৩টি হোটেলের একটির সামনে। সেখানে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে, চললাম হা-জং দেখতে। কিন্তু জং-এর সংস্কার কাজ চলতে থাকায় তার ফটক বন্ধ। তিন দিকে উঁচু পাহাড় ঘেরা থাকলেও হা-তে হাওয়ার তীব্রতা বেশ বেশি। তবুও পায়ে হেঁটে হাুরে বেড়িয়ে দেখা বেশ উপভোগ্য। আর পারো থেকে হা-র পথের সৌন্দর্য তো অসাধারণ। যখন ফিরে এলাম, পারোতে তখন পড়ন্ত বিকেল। |
|
পরদিন পারোর অলিগলি ঘুরে দেখার পালা। প্রথমেই গেলাম পা-চু’র উপর কাঠের সেতু পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত রিনপুং জং তথা পারো জং দেখতে। ভুটানের অন্যান্য জঙ্গলের মতোই এটিও আয়তনে বিরাট এবং অসাধারণ ভুটানি স্থাপত্যের নিদর্শনবাহী।
পরের দ্রষ্টব্য পারো মিউজিয়াম। এর প্রকৃত নাম ‘তা জং’। এখানে ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ৫০ টাকা। থরে থরে পাথর সাজিয়ে গড়ে তোলা আটতলা এই মিউজিয়ামটি অর্ধগোলাকার চোঙের আকৃতিসম্পন্ন এবং এর নির্মাণশৈলীও বিস্ময়কর। মিউজিয়ামের প্রবেশপথটি গিয়ে উঠেছে সোজা পাঁচতলায় এবং বেরোনোর পথ একতলায়। ভিতরে কাঠের সিঁড়ি ও করিডর। অত্যন্ত মূল্যবান ও দর্শনীয় এই সংগ্রহশালায় রয়েছে প্রাচীন ভুটানে ব্যবহৃত রাজপোশাক, রুপো ও পিতলের অলঙ্কারাদি, তামার পানপাত্র, বিবিধ অস্ত্রশস্ত্র, ব্রোঞ্জ ও হাতির দাঁতের বুদ্ধমূর্তি, প্রাচীন ভুটানি মুদ্রা ও ধাতব হরফ এবং বহু অমূল্য বস্তুর বিরল সংগ্রহ। মিউজিয়ামের শীর্ষতলের কেন্দ্রে অবস্থিত ‘ছোগঝিং লাখাং’-এ মহায়ন বুদ্ধ ও বুদ্ধত্ব সম্পর্কিত অন্যান্য মূর্তিগুলির নিখুঁত সূক্ষ্ম ভাস্কর্য দেখেও মুগ্ধ হতে হয়।
সম্পূর্ণ পারো উপত্যকাকে পাখির চোখে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় এই মিউজিয়াম চত্বর থেকেই।
মধ্যাহ্নভোজের পর দ্বিতীয়ার্ধে চললাম ‘কিচু লাখাং’ দেখতে। চকচকে পথ ধরে ৪-৫ কিমি যেতে না যেতেই পথের দু’ধারে আপেলবাগানের ছড়াছড়ি। আরও এগোতেই দেখলাম, মন ভরানো চাষের খেতে কোথাও কচি কচি ধানগাছ, কোথাও বা যবগাছ। জনপ্রিয় ভুটানি চাল রেড রাইস-এর সিংহভাগই উৎপন্ন হয় পারোতে। শহরের চাকচিক্যের সঙ্গে গ্রাম্য সৌন্দর্যের দুর্দান্ত মিশেলে পারোর নিসর্গ এক কথায় অপূর্ব! |
|
কি-চু লাখাংয়ের বুদ্ধমন্দিরটি আয়তনে বেশ ছোট এবং এর চাকচিক্যও কম। কিন্তু ভিতরে বুদ্ধের বিরাট মূর্তি। মূল মন্দিরের গা ঘেঁষে দণ্ডায়মান লম্বা একটি কমলালেবু গাছবড় বড় পাকা কমলালেবুতে ভর্তি।
এখান থেকে গিয়ে আবার থামলাম সাসামে। বাঁ দিকে টানা আপেলবাগান আর ডান দিকে বিস্তৃত যবখেতের পিছনে খাড়া পাথুরে পাহাড়ের উপর নির্মিত ‘টাইগারস নেস্ট’
মনাস্ট্রি তথা তাকসাং মনাস্ট্রি। একটি খাড়া পাহাড়ের পাথুরে গা বেয়ে এত বড় একটি মনাস্ট্রি কী ভাবে নির্মিত হয়েছিল, ভাবলেই অবাক লাগে। এখানে পৌঁছানোর জন্য বেশ খানিকটা দূরত্ব পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করতে হয়। কিন্তু আমাদের শিশু সঙ্গীদের কথা ভেবে
আমরা এই আশ্চর্য মনাস্ট্রি-টি দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট থাকলাম।
সন্ধেটা কাটল পা-চু’র ধারে বসে, পারোর আকাশে রং-বদলের মোহময় খেলা দেখে। যদিও আঁধার ঘনাতেই বিষাদ ভর করল মনে। কাল ভোরেই পারোর সুখসঙ্গ ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু তার স্মৃতি...না, সে কখনওই ভোলার নয়!
|
কী ভাবে যাবেন |
রেলপথে আলিপুরদুয়ার বা হাসিমারা। সেখান থেকে বাসে অথবা
গাড়ি ভাড়া করে জয়গা। অথবা ফুন্টসোলিং থেকে গাড়িতে সরাসরি পারো।
আর বিমানে গেলে দমদম বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পারো। |
|
কোথায় থাকবেন |
অজস্র হোটেল আছে পারোতে। বেছে নিন নিজের পছন্দমতো। |
|
মনে রাখবেন |
(১) পারো ভ্রমণের পারমিট বানাতে হবে ফুন্টসোলিংয়ে। আর বিমানে গেলে
পারমিট হবে পারো বিমানবন্দরে। প্রত্যেকের সচিত্র পরিচয়পত্র (পাঁচ বছরের বেশি
শিশুদের জন্য স্কুলের আইডেন্টিটি কার্ড) ও ৪-৫ কপি ফটো সঙ্গে নেবেন।
(২) ধূমপান কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ও আইনত দণ্ডনীয়।
প্রকাশ্যে কখনওই ধূমপান করবেন না।
(৩) ভুটানি মুদ্রা নালট্রাম ও ভারতীয় টাকার মূল্য সমান।
৫০০ ও ১০০০ টাকার ভারতীয় নোট চলবে না।
(৪) শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকলে সঙ্গে ওষুধ রাখুন। |
|
|
|