রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
এই না হলে হাই-টেক কোচ! চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মাঝপথেই ইউরোপের একমাত্র বাঙালি কোচের মাথায় পরের বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ!
দমদম মতিঝিলে সব্যসাচী দত্তের পারিবারিক বাড়ি আর নেই। বাহান্ন বছর হল তিনি জার্মানিতে। স্টুটগার্ট থেকে বছর দুই অন্তর কলকাতা এলে ওঠেন হোটেলে। কল্যাণীতে দাদা। বেলেঘাটায় দিদি। যাদবপুরের ঝিল রোডে যৌথ পরিবারের দুর্গাপুজোটা হয় এখনও।
সেই পরিবারের ছেলেই রবিন এখন জার্মানির সবচেয়ে আলোচিত তরুণ কোচ। ইউরোপের একমাত্র এশীয় বংশোদ্ভূত কোচের কোচিংয়েই খেলেন জার্মানির সুপারস্টার মাইকেল বালাক।
আপনার প্রধান লক্ষ্য কী এখন? জার্মানির স্টুটগার্ট থেকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রবিনের জবাব, “আমরা আবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে পৌঁছতে চাই। অন্তত এটাই লক্ষ্য।” মানে স্পষ্ট, অনাবাসী বাঙালির লক্ষ্য বুন্দেশলিগায় প্রথম চারটে দলের মধ্যে থাকা। জার্মানির সেরা চারটি ক্লাব চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলতে পারবে পরের বছর। রবিনের দল এ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চেলসির কাছে অ্যাওয়ে ম্যাচ হেরে বেলজিয়ামের জেঙ্ককে হারিয়ে গ্রুপে এখন দুই নম্বরে। সামনের বুধবার রবিনের সামনে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া।
বুন্দেশলিগায় পয়েন্টের তালিকায় তাঁর ক্লাব বায়ার লিভারকুসেন যৌথ ভাবে চার নম্বরে। গতবার ছিল রানার্স। এ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া কি সম্ভব? সব্যসাচী দত্তের ছেলের সোজা কথা, “গত কয়েক বছর অন্য ক্লাবগুলোর জার্মান চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব হয়েছে তখনই, যখন বায়ার্ন মিউনিখ খুব খারাপ খেলেছে। এই মুহূর্তে আমাদের খুব তরুণ দল। যদি এই দলটাকে আমরা ধরে রেখে তৈরি করতে পারি, তা হলে পরের বছরগুলোতে আমাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব।” এই ক্লাবেই কোচিং করিয়েছেন রেনাস মিশেলস, ডেটমার ক্র্যামার, বার্তি ফোকস, রুডি ফোলার, ক্লাউস আউগেনথেলার। এখন সেই পদে দমদম মতিঝিলের দত্ত বাড়ির ছেলে।কলকাতায় শেষ বার এসেছেন বছর তিরিশ আগে। রবিন বাংলা বলতে পারেন না, বুঝতেও না। বাবা সব্যসাচী দত্ত রাজস্থানে কোটায় চাকরি সূত্রে ছিলেন। ওই সময় কিশোর রবিন কিছু হিন্দি শিখেছিলেন। ভুলে গিয়েছেন দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসে। বালাকের মতো কিংবদন্তিকে কোচ করতে পারা কেমন অভিজ্ঞতা? রবিন উত্তর দেন, “ওর মতো অভিজ্ঞ ফুটবলারকে দলে পাওয়া দারুণ ব্যাপার। তবে এক জন কোচ হিসেবে এক জন ফুটবলারকে পুরো দলের উপরে তোলার ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হবে।” |
বালাককে নির্দেশ দিচ্ছেন রবিন। |
তাঁর ছাত্র বালাকের সঙ্গে জাতীয় কোচ জোয়াকিম লো-র ঝামেলায় জার্মান সুপারস্টারকে আর জাতীয় দলে ফেরানো হয়নি। বালাক আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেননি। আবার একশো ম্যাচ খেলে অবসর নেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর পক্ষে কি র্জামান দলে ফেরা সম্ভব আর? বালাকের বাঙালি কোচকে অনেককেই দেখছেন ভবিষ্যতের জার্মান কোচ হিসেবে। তাঁর স্পষ্ট উত্তর, “না। জার্মানি দলে বালাকের ফেরা সম্ভব নয়। জার্মান ফেডারেশনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা একেবারে ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
বালাকের পক্ষে পুরো ফিট হওয়া সম্ভব কি না এই প্রশ্নটা উঠল। এবং বালাকের বাঙালি কোচ বলে দিলেন, “ও ইতিমধ্যেই ফিট। এখন ওর পঁয়তিরিশ চলছে। তা সত্ত্বেও ও মাঠে দলকে অনেক গুছিয়ে তুলতে পারে। যথেষ্ট সফল।” বোঝা গেল, বুন্দেশলিগায় আবার নিজস্ব ছন্দে ফেরা বালাককে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও অস্ত্র করতে পারেন তিনি। জার্মানি ফুটবলে বালাকের পরবর্তী সুপারস্টার কে হবেন? সোয়াইনস্টাইগার-মুলার-পোদলস্কির বাইরে তিনটি নাম করলেন রবিন। রিয়াল মাদ্রিদের মেসুট ওজিল, বোরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মারিও গোয়েৎসে এবং তাঁর নিজের ক্লাবের আন্দ্রে সুর্লে। “জার্মান ফুটবলে কোনও টিপিক্যাল সুপারস্টার নেই। কিন্তু জার্মান দলের এই তিন জন তরুণ সুপারস্টার হতে পারে।”
বড় দলে কোচ হওয়ার বড় হ্যাপা। সরাসরি কথা বলা মানা। ক্লাবের মিডিয়া অফিসারের মাধ্যমেই সাক্ষাৎকার দিতে হয়। লেভারকুসেনে আসার আগে ফ্রেইবুর্গ ক্লাবে ছিলেন রবিন। সেখানেই তাঁর উত্থান, সেখানে এত ঝামেলা ছিল না। লেভারকুসেনে তাঁকে এনেছেন, ক্লাবের স্পোর্টিং ডিরেক্টর, কিংবদন্তি রুডি ফোলার। ফ্রেইবুর্গের সঙ্গে লেভারকুসেনের পরিবেশের ফারাক কী জানতে চাইলে রবিন অকপট, “প্রত্যাশা ও দাবি এখানে অনেক বেশি। লিগের প্রথম ছ’টা দলের মধ্যে থাকতে হবেই। এমন আশা সবার। তবে প্লেয়াররাও এখানে অনেক ভাল মানের।” তার পরে ফিরে গেলেন বুন্দেশলিগার মানের প্রসঙ্গে। “বুন্দেশলিগায় কেউ ফেভারিট নয়। প্রথম সারির যে কোনও দল চমকে দিতে পারে। যে কোনও দল যে কোনও দলকে হারাতে পারে।”
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বা লা লিগার তুলনায় ইতালির সিরি এ এবং জার্মানির বুন্দেশলিগা সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তায় অনেক পিছিয়ে। রবিন নিজে মানতে চাইলেন না। এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে তাঁর পাল্টা যুক্তি, “আমি এখানে আপনার মন্তব্য মানি না। জার্মানিতে ইউরোপের সেরা স্টেডিয়াম রয়েছে। সব সময় সব ম্যাচে ভর্তি থাকে স্টেডিয়াম। জার্মানি জাতীয় দল ইউরোর প্রাথমিক পর্বে সব ম্যাচ জিতেছে। যে কোনও দেশের লিগের তুলনায় বুন্দেশলিগায় অনেক ভারসাম্য রয়েছে।”
স্টুটগার্টে বাড়ি, এখন থাকেন কোলনেযে শহরে জন্ম। সেখান থেকেই রবিনের যাতায়াত লেভারকুসেনে। রবিনের বিশ্লেষণ চমৎকার, “অর্থের দিক দিয়ে বুন্দেশলিগার ক্লাবগুলো হয়তো ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মতো রোজগার করে না। কিন্তু আর্থিক কাঠামো অনেক ভাল। সারা বিশ্বের দুশোটা দেশে বুন্দেশলিগার ম্যাচ দেখানো হয় সরাসরি। বিভিন্ন দেশের প্লেয়াররা খেলে। এ তো অনেক বড় ব্যাপার।”
বালাকের বাঙালি কোচের জার্মান জাত্যাভিমান এখানেই ঠিকরে বেরিয়ে এল! |