|
|
|
|
উন্নয়নের সঙ্গে দেবেন কড়া বার্তাও |
হুমকির মধ্যেই আজ জঙ্গলমহলে মমতা |
অনিন্দ্য জানা • কলকাতা |
অতঃপর জঙ্গলমহল।
তিন দিনের উত্তরবঙ্গ সফরে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স নিয়ে যথেষ্টই ‘আশ্বস্ত’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। উত্তরের সফর সেরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি ফিরেছেন কলকাতায়। এবং বিমানবন্দর থেকেই সটান দৌড় মেরেছেন মহাকরণে। গত তিন দিনের বকেয়া কাজ সেরে ফেলতে।
একই সঙ্গে, আগামী দু’দিনের কাজ খানিকটা এগিয়ে রাখতেও।
কারণ, আজ শুক্র এবং আগামিকাল, শনিবার মিলিয়ে যে দিন দেড়েকের সফর তিনি করতে চলেছেন, তা সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আরও বেশি ‘গুরুত্বপূর্ণ’। উত্তরবঙ্গে মমতার প্রশাসনিক সত্ত্বার সঙ্গেই মিশে ছিল তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বাও। যে রাজনীতিক চান, দক্ষিণের মতো উত্তরেও তাঁর দলের ঝান্ডা গভীর ভাবে পুঁতে দিতে। কিন্তু, আজ শুক্রবার যে মমতার মেদিনীপুর রওনা দেওয়ার কথা, তিনি একান্ত ভাবেই রাজ্যের ‘মুখ্য প্রশাসক’। যে সফরে তিনি যেমন পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাসদরে জেলার পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে উন্নয়ন নিয়ে বৈঠক করবেন, তেমনই যাবেন ঝাড়গ্রামে। মাওবাদী-অধ্যুষিত এলাকায় দাঁড়িয়ে প্রশাসনিক সভা করতে। পাশাপাশি, যাবেন মাওবাদীদের ‘বার্তা’ দিতেও। |
|
উড়ানেও ব্যস্ত তিনি। কলকাতা ফেরার পথে। ছবি: অশোক মজুমদার |
রাজ্য প্রশাসনের কাছে মমতার জঙ্গলমহল-সফর আরও ‘তাৎপর্য’ পেয়েছে এ দিন মাওবাদীদের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ্যে আসায় এবং এ দিনই ঝাড়গ্রামের অদূরে সর্ডিহা স্টেশনের (এখানেই জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ড ঘটেছিল) কাছে ল্যান্ড-মাইন আতঙ্ক তৈরি হওয়ায়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে জঙ্গলমহলে সভা না-করার জন্য এবং জঙ্গলমহলের মানুষকে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় না-আসার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও প্রশাসনের কাছে খবর পৌঁছেছে। সরডিহায় উদ্ধার-করা পোস্টারেও তার প্রমাণ মিলেছে। অবশ্য সরডিহায় রেললাইনে ল্যান্ড-মাইন প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার-মাওবাদী মধ্যস্থতাকারীদের অন্যতম সুজাত ভদ্র জানান, ওই কাজ মাওবাদীদের নয়। ওটা অন্য কেউ করেছে।
মমতা নিজে ওই বিষয়ে বিশদে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে তাঁর সফর যথারীতি জারি থাকছে। যা থেকে স্পষ্ট, এই ঘটনাপ্রবাহকে তিনি কোনও ‘বাড়তি গুরুত্ব’ দিতে নারাজ। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতা শুধু বলেছেন, “আমাদের বিশ্বাস, জঙ্গলমহলের মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আছেন। এই ঘটনায় প্রমাণিত হল যে, মাওবাদীরা ভয় পেয়েছে। তাই ভয় দেখাচ্ছে!”
প্রসঙ্গত, মমতার সফরের আগে জঙ্গলমহলের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে গত সোমবারই সেখানে গিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগের দিন ল্যান্ড-মাইন আতঙ্কের ঘটনায় প্রশাসন খানিকটা উদ্বিগ্ন। যার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বলয় আরও কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি, এ দিনই মাওবাদী নেতা আকাশের নামে জারি করা বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, রাজ্য সরকার যেন ‘শান্তি-প্রক্রিয়া’ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করে। সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠানো বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ১৫ দিন আগে ‘অস্ত্র-সংবরণ’ সংক্রান্ত বিবৃতি দেওয়ার পরেও রাজ্য সরকার ওই বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি (আগের বিবৃতিটিতে আকাশের সঙ্গেই সই ছিল রাজ্য সরকার-মাওবাদী মধ্যস্থতাকারী সুজাত ভদ্র এবং ছোটন দাসেরও। যাতে বলা হয়েছিল, সরকার জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান বন্ধ রাখলে তারা এক মাসের জন্য অস্ত্র-সংবরণ করবে)। বরং ওই বিবৃতির পর জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান আরও বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকার আগের বিবৃতিটি নিয়ে মুখ খোলেনি। কারণ, সরকারের তরফে ওই বিবৃতির ‘সত্যতা’ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই বিষয়েও এ দিনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সুজাত-ছোটনের সই থেকেই স্পষ্ট যে, বিবৃতিটি সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে রাজ্য সরকার ওই বিষয়ে দুই মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে কথাও বলে নিতে পারে বলে এ দিনের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। |
|
বাগডোগরা বিমানবন্দরের পথে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
প্রশাসনের একাংশ অবশ্য আগেই ওই বিবৃতিতে দুই মধ্যস্থতাকারীর সই নিয়ে কিঞ্চিৎ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলেছিলেন, “যাঁরা সরকারের সঙ্গে মাওবাদীদের আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন, তাঁরা কী করে এমন একটি বিবৃতিতে সই করলেন, যাতে সরকারের উপরে শর্ত চাপানো হয়েছে? সে ক্ষেত্রে তো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁদের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে!”
আকাশের নামে জারি-করা এ দিনের বিবৃতিও রাজ্য সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে পৌঁছয়নি। তবে পৌঁছলেও রাজ্যের এই বিবৃতি নিয়েও কোনও বাক্যব্যয় করবে না বলেই প্রশাসনিক সূত্রে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে অবশ্য ‘বেসরকারি স্তরে’ বিবৃতির খবর পৌঁছেছে। প্রত্যাশিত ভাবেই তিনিও ওই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সফরের অব্যবহিত আগে ওই বিবৃতিকে খুব একটা ‘গুরুত্ব’ দিতে চাইছেন না। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “রাজ্য সরকারের যা বক্তব্য, তা মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহল সফরে গিয়ে জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে বলবেন। রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হিসেবে তাঁর দায়বদ্ধতা জঙ্গলমহলের বাসিন্দা আমজনতার প্রতি। মাওবাদীরা তো আর জঙ্গলমহলের সেই সব মানুষের প্রতিনিধি নয় যে, তাদের নামে জারি-করা বিবৃতিকে গুরুত্ব দিতে হবে!” আকাশের নামে জারি-করা বিবৃতিতে জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান বৃদ্ধি পাওয়ার কথা দাবি করা হলেও ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু বলেছে, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান বন্ধ রয়েছে। যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেমন রাজ্যের বিরোধীদলের তরফে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনই একাধিক বার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অভিযান বন্ধ থাকার কারণ দেখিয়ে জঙ্গলমহল থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী তুলে নিতে চেয়েছে। তার মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি ঠেকিয়েছিলেন। ফলে এ দিনের বিবৃতির ওই অংশটিও ‘অসত্য’ বলেই মনে করছে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। যার ফলে গোটা বিবৃতিটি নিয়েই ‘সংশয়’ দেখা দিয়েছে। |
|
উত্তরবঙ্গ সফর সেরে ফের মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র |
মুখ্যমন্ত্রীর জঙ্গলমহল সফরে যোগ দেওয়ার কথা কেন্দ্রের দুই মন্ত্রী মুকুল রায় (মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই মুকুলবাবুকেও খুনের হুমকি দিয়েছে মাওবাদীরা), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। ঝাড়গ্রামে সরকারি কর্মসূচির আগে মেদিনীপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা খতিয়ান নেবেন কয়েক মাস আগে তাঁর জঙ্গলমহল-সফরের পর কোন কোন ক্ষেত্রে কী কী কাজ করা হয়েছে, সেই বিষয়ে। শনিবারের সরকারি কর্মসূচিতে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছাত্রাবাস, সেতুর শিলান্যাস- সহ বেশ কিছু উন্নয়নের কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা মুখ্যমন্ত্রীর।
মাওবাদীদের উদ্দেশে কি তিনি কোনও ‘কড়া বার্তা’ দেবেন এই সফরে? এই প্রশ্নের জবাবে এখনও কিছু বলতে রাজি হননি মুখ্যমন্ত্রী। তার কারণও সহজবোধ্য আগে থেকে মুখ খুলে তিনি মাওবাদীদের ‘সতর্ক’ করে দিতে চান না। তবে ‘শান্তি-প্রক্রিয়া’য় বিশ্বাস করলেও মমতা যে তার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করবেন না, সেটা তিনি মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকেও একাধিক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, মমতা এখনও চান, রক্তপাত বন্ধ করে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এবং পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন করতে। তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার কথায়, “আলোচনায় সমাধান হলে সবচেয়ে ভাল। কিন্তু আলোচনা, মধ্যস্থতা বা শান্তি-প্রক্রিয়া চলতে চলতে যদি ওরা আবার খুনের রাজনীতি শুরু করে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী কঠোর হতে বাধ্য হবেন।”
বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর দল এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের একাংশ এখনও মনে করে, যথেষ্ট হয়েছে! এই ‘তথাকথিত’ (মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রকাশ্যেই ওই মাওবাদীদের ‘জঙ্গল-মাফিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন এবং সেই বক্তব্য থেকে সরে আসার কোনও কারণ তিনি এখনও দেখছেন না বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন) মাওবাদীদের কঠোর হাতে দমন করার সময় এসেছে। ওঁরা এমনও মনে করেন যে, আরও আগেই মুখ্যমন্ত্রীর কড়া হওয়া উচিত ছিল। যদিও তার সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি।
এই পটভূমিকায় মমতা ঝাড়গ্রামের সভায় কী বলেন, তা নিয়ে তীব্র কৌতূহল এবং আগ্রহ তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের একাংশ মনে করছে, যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে মাওবাদীরা পোস্টার দিয়ে এবং ল্যান্ড-মাইন বিছিয়ে ‘আতঙ্ক’ তৈরি করার চেষ্টা করছে, তাতে তারা ‘কড়া অবস্থান’ নেওয়ার দিক দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আরও সুবিধাই করে দিল। আবার অন্য একাংশের মতে, এর ফলে জঙ্গলমহলের মানুষের একাংশ ভয় পেয়ে যদি মুখ্যমন্ত্রীর সভায় না-আসেন, তা হলে মাওবাদীরা খানিকটা ‘সুবিধা’ পেয়ে যেতে পারে। তবে প্রশাসনের বড় অংশ মনে করছে, সরকার-মাওবাদী ‘সঙ্ঘাত’ অবশ্যম্ভাবী। এবং তা চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকেই এগোচ্ছে।
দেখার, কে আগে পলক ফেলে! |
|
|
|
|
|