|
|
|
|
সর্ডিহায় রেললাইনে আবার মাইন-আতঙ্ক |
নিজস্ব সংবাদদাতা • ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুর |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরের মুখে জ্ঞানেশ্বরী-নাশকতার স্মৃতিবাহী সর্ডিহায় রেললাইনে টিফিন কৌটো ঘিরে ফের ছড়াল মাইন-আতঙ্ক। এবং কৌটোর সঙ্গেই রেললাইন থেকে উদ্ধার হল তিনটি মাওবাদী-পোস্টারও।
তিনটি পোস্টারের একটিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছে। আর একটিতে জঙ্গলমহলের যুবকদের পুলিশে নিয়োগের বিরোধিতা করা হয়েছে। তৃতীয় পোস্টারে হুমকি দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় ও সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে, যে দু’জনই মূলত জঙ্গলমহলে তৃণমূলের সাংগঠনিক কাজকর্মে নেতৃত্ব দেন। তবে কৌটো ও পোস্টার মাওবাদীরাই রেখেছে, না অন্য কোনও ‘চক্র’ তা নিয়ে সংশয় রয়েছে প্রশাসনেও।
মাইন পাওয়ার পরে দীর্ঘ ক্ষণ বিভিন্ন স্টেশনে কয়েকটি ট্রেনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত কৌটোর মধ্যে থেকে মিলল মাটি-পাথর। তত ক্ষণে রাত হয়ে গিয়েছে। কৌটো-রহস্য সমাধানের পরেও নিরাপত্তা নিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে তবেই ট্রেন ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পুরো সময়টায় আরও এক বার চরম ভোগান্তির শিকার হলেন রেলযাত্রীরা। |
|
উদ্ধার হওয়া মাওবাদী পোস্টার। |
আজ, শুক্রবারই মেদিনীপুরে পৌঁছনোর কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আর কাল, শনিবার ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে তিনি সভা করবেন। খড়্গপুর-জামশেদপুর লাইনে ঝাড়গ্রামের ঠিক আগের রেলস্টেশন সর্ডিহার কাছে আপ-লাইনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মুখে একটি টিফিন কৌটো পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয় কয়েক জন। ঠিক পাশেই কয়েকটি পোস্টারও পড়ে থাকতে দেখা যায়। সর্ডিহার স্টেশনমাস্টারের কাছে খবর পৌঁছয়। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছয় যৌথ বাহিনীও। মেদিনীপুর থেকে বম্ব-স্কোয়াডকেও ডাকা হয়। রাতে জঙ্গলঘেরা রেল লাইনে কৌটোটি উদ্ধারের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি বাহিনী। রেল লাইনে সন্দেহজনক বস্তু পড়ে থাকায় সন্ধ্যার পরে আর ট্রেন চালানোর ঝুঁকি নেননি রেল-কর্তৃপক্ষও। খড়্গপুর, কলাইকুণ্ডা ও চাকুলিয়া স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে আপ স্টিল এক্সপ্রেস, একটি ডাউন ও একটি আপ লোকাল ট্রেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যাত্রীরা। চরম ভোগান্তির শিকার হন তাঁরা।
রাত দশটা নাগাদ পৌঁছয় বম্ব-স্কোয়াড। দেখা যায় টিফিন কৌটোর মধ্যে আছে পাথর, মাটি। ঘণ্টাদেড়েক পরে, সাড়ে ১১টা নাগাদ পুলিশের কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পেয়ে বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনগুলিকে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে রওনা করানোর কাজ শুরু করেন রেল-কর্তৃপক্ষ। ‘পাইলট’ হিসাবে আপ-লাইনে আগে একটি মালগাড়ি চালানো হয়। ২০১০ সালের ২৭ মে জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডের পরে রাত দশটার পরে এই রেলপথে এমনিতে অবশ্য ট্রেন চলাচল বন্ধ।
যেখানে এ দিনই সংবাদমাধ্যমে পৌঁছনো মাওবাদী রাজ্য সম্পাদক আকাশের বিবৃতিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে অবিলম্বে আলোচনা শুরুর আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে, সে-সময়ে মাওবাদীরা রেললাইনে ফের মাইন-আতঙ্ক ছড়াবে কেন--সে প্রশ্ন উঠেছে। অন্য কোনও ‘চক্র’ মুখ্যমন্ত্রীর জঙ্গলমহল সফরের আগে আতঙ্ক ছড়াতে এ কাজ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার সুপার গৌরব শর্মার বক্তব্য, “মাওবাদীদের নামেই পোস্টারগুলি পড়েছিল। কিন্তু ঠিক কে বা কারা কৌটো-পোস্টার রাখল, তা তদন্তসাপেক্ষ।” ঝাড়গ্রামের তৃণমূল বিধায়ক তথা পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদারও মন্তব্য, “এখনই নির্দিষ্ট বলা সম্ভব নয়, কারা এর পিছনে।”
এ দিকে, বুধবার বিকেলে লালগড়ের ধরমপুর থেকে লসো হেমব্রম নামে এক ‘মাওবাদী স্কোয়াড-সদস্যকে’ ধরা হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। আর বৃহস্পতিবার শালবনি-গড়বেতা থেকে উদ্ধার হয়েছে বেআইনি অস্ত্র-কার্তুজ। সব মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের মুখে পুলিশমহলে ‘টেনশন’ কিন্তু বাড়ছে। |
|
উদ্ধার হওয়া কৌটো। বৃহস্পতিবার। |
লালগড়ের ধরমপুর থেকে ধৃত লসো হেমব্রম সম্পর্কে পুলিশের দাবি, ওই যুবক টোটা-বাদল-সুচিত্রার মতো মাওবাদী নেতানেত্রীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। গত বছর ১২ এপ্রিল লালগড়ের গোহমিডাঙায় সুবোধ মণ্ডল নামে এক জনকে ‘পুলিশের চর’ সন্দেহে খুন করেছিল মাওবাদীরা। পুলিশের দাবি, লসো ওই খুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত। এ ছাড়া, ২০০৯-এর জুলাইয়ে লালগড়ের বৃন্দাবনপুর থেকে সাবির মোল্লা ও কাঞ্চন গড়াই নামে দুই পুলিশকর্মী অপহরণের ঘটনাতেও তাঁর হাত রয়েছে। আরও কয়েকটি মামলাতেও তাঁকে খোঁজা হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার ধৃতকে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতে হাজির করা হয়। ভারপ্রাপ্ত বিচারক রোহন সিংহ তাঁকে ৭ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। ধৃতের আইনজীবী কৌশিক সিংহের অবশ্য দাবি, এলাকায় প্রতিবাদী যুবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলেই তাঁর মক্কেলকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
ধরপাকড়ের পাশাপাশি বৃহস্পতিবার জেলার শালবনি ও গড়বেতা থেকে উদ্ধার হয়েছে ৭টি বন্দুক ও ১০ রাউন্ড কার্তুজ। তৃণমূলের দাবি, সিপিএমের ‘সশস্ত্র বাহিনী’ই এক সময়ে এই সব অস্ত্র মজুত করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে, কারা, কী উদ্দেশ্যে অস্ত্র জড়ো করেছিল, তার তদন্ত শুরু হয়েছে। শালবনির পিরাকাটা থেকে গোয়ালতোড়ের দিকে জয়পুরে রাস্তার ধারে এ দিন ৪টি বন্দুক পড়ে থাকতে দেখেন গ্রামবাসীরা। খবর পেয়ে পৌঁছয় পুলিশ। এ দিনই গড়বেতার চাঁদাবিলা থেকেও ৩টি বন্দুক ও ১০ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করে পুলিশ। একটি ঝোপের মধ্যে এই বন্দুক ও গুলি পড়েছিল। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে পৌঁছয় পুলিশ। জঙ্গলমহলের অন্য জেলা বাঁকুড়ার তালড্যাংরা থানার পাঁচমুড়া গ্রামের একটি মাঠ থেকেও এ দিন সকালে গুলিভর্তি একটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার হয়।
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|