‘বদলা’ নয়, বদলের আশায়
বিপণন বড় বালাই। তাই স্পনসররা আপ্রাণ ধুয়ো তোলার চেষ্টা করছেন, এটা নাকি ‘বদলা’-র সিরিজ। একরকম জবরদস্তি করেই প্রতিশোধের তকমা লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া পাঁচ ম্যাচের সিরিজের সর্বাঙ্গে। স্টেডিয়ামের চারপাশে যা কিছু ব্যানার, পোস্টার, হোর্ডিং, তার একটাই নির্যাস। হোয়াইটওয়াশের পাল্টা ‘ব্রাউনওয়াশ!’ ভাবটা এমন, নাকে খত দিয়ে টিম বিলেত থেকে ফিরেছে তো কী হয়েছে, এই তো কেমন সাহেবদের মুখে পাল্টা ঝামা ঘষে দেওয়ার সুযোগ নাকের ডগায় ঝুলছে। সুতরাং ‘চলো, লেটস গো’!
উপরে যা পড়লেন, পুরোটাই কল্পনা। এমন কিচ্ছু আদৌ ঘটছে না নিজামের রাজ্যে। কারণ, ‘বাস্তব’ যে আরও বড় বালাই। সেই বিশ্বকাপ থেকে শুরু হয়ে ‘টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন’ ক্রিকেট চলছে তো চলছেই। আইপিএল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, ইংল্যান্ড সফর, দেশে ফিরতে না ফিরতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, শেষ হতে না হতেই এই আবার শুরু। বড্ড বেশি ক্রিকেটের বদহজম তো আছেই। তা-ও বিশ্বজয়ের রেশটা ধোনিরা ধরে রাখতে পারলে একটা কথা ছিল। মাসকয়েকের মধ্যে টেস্ট ও ওয়ান ডে র্যাঙ্কিংয়ে নেমে যাওয়া, ইংল্যান্ড থেকে দুরমুশপেটা হয়ে ফেরা, তারকাদের না থাকা—এতগুলো নেতিবাচক অনুষঙ্গ কাটিয়েও ৩৯ হাজারের গ্যালারি হয়তো ভরেই যাবে। সৌজন্য কমপ্লিমেন্টারি টিকিট। কিন্তু তাতে কি আদৌ জৌলুস বাড়বে এই চাকচিক্যহীন সিরিজের? ভরদুপুরে উত্তর দেওয়ার সময় উদাস লাগে হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সচিব ডি এস চ্যালাপথিকে “সচিনদের না থাকাটা বড় ফ্যাক্টর। তা ছাড়া বদলা নেওয়ার ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?”
নেটে বিরাট কোহলি।ছবি: উৎপল সরকার
শুনে মনে হল, বলি, কীসের বদলা? এ কি আটের দশকের হিন্দি সিনেমা নাকি, যে দাঁত মুখ চেপে ‘খুন কা বদলা খুন’ বললেই স্ক্রিপ্ট সেই অনুযায়ী ক্লাইম্যাক্সের দিকে রওনা দেবে? খুনের বদলে খুন, মানে ‘ব্রাউনওয়াশ’ করতে হলে পাঁচটা ওয়ান ডে আর একটা টি-টোয়েন্টি, সব জিততে হবে ধোনির এই ভাঙাচোরা টিমকে। যাদের পেস অ্যাটাক বলতে প্রবীণ কুমার, উমেশ যাদব, বিনয় কুমার, শ্রীনাথ অরবিন্দ, বরুণ অ্যারন! শেষের জনের এখনও ওয়ান ডে অভিষেকই হয়নি! পেসাররা সবাই মিলে যতগুলো ওয়ান ডে খেলেছেন, একা জাহির খেলছেন তার তিনগুণের বেশি। এই বোলিং নিয়ে পারা যাবে ইংরেজদের সামলাতে? অবধারিত প্রশ্ন এল ধোনির দিকে আর পত্রপাঠ ক্যাপ্টেন তাই বললেন, যা এই পরিস্থিতিতে রাম শ্যাম যদু মধুও বলবে—“এভাবে দেখছেন কেন? জুনিয়রদের কাছে এটা নিজেদের প্রমাণ করার, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সব কিছু বদলে দেওয়ার একটা বড় সুযোগ।’’ বলতে হয় বলে বলা, আনকোরাদের মনোবল ধাক্কা খেতে পারে বলে বলা। এক যদি অশ্বিনকে খেলতে কিছুটা ঝামেলায় পড়ে ইংল্যান্ড, তা হলেই কিছুটা অক্সিজেন পেতে পারে টিমের বোলিং ফুসফুস। না হলে এই বোলিং নিয়ে খুন তো দূরস্থান, দু’চারটে ‘জখম’ করতে পারলেই যথেষ্ট।
বরং ভরসার টিমটিমে আলো যদি বা কিছু থাকে, সেটা ব্যাটিং নিয়েই। ঘরের মাঠ, ইংল্যান্ডের মতো ত্রাহি ত্রাহি সুইংয়ের ব্যাপার নেই। গম্ভীরকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দেখে মনে হয়নি, চোটের কোনও রেশ আছে। ওপেনার পার্থিব, যার ব্যাটিং ইদানীং চোখে পড়ার মতো ডাকাবুকো। আছেন প্রতিশ্রুতিমান রাহানেও। রায়না-কোহলিদেরও তো আর জুনিয়র বলা যাবে না। দু’জনেই নিজেদের মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত ‘মস্তান’। এটা টেস্ট নয় যে টেকনিকের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। লাগাতার বিশ্বমানের সুইং বোলিংয়ের জ্বালা নেই যে খাবি খেয়ে যেতেই হবে। বল কথায় কথায় বুকেও আসবে না। তাই ক্রিজে ‘ধিংকা-চিকা’ নাচেরও প্রশ্ন নেই। বরং এই মওকায় একটা দুটো ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি করে আবার কলার তুলে ঘোরার সুযোগ আছে। ইংল্যান্ড সফরের হামাগুড়ি-উপাখ্যান ভুলে গিয়ে লোকে তখন আবার মাথায় তুলে নাচবে।
আর ক্যাপ্টেন স্বয়ং। ইংল্যান্ড সফরের পর যিনি ‘ক্যাপ্টেন কুল’ থেকে রাতারাতি ‘ক্যাপ্টেন ক্রাম্বলিং’? বাইরে থেকে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। আপাত নির্বিকার ভাবটা ধরে রেখেছেন বহিরঙ্গে। কিন্তু ভেতরে একটা টালমাটাল যে চলছেই, সেটা বুঝতে মগজাস্ত্র প্রয়োগের দরকার পড়ে না। তারকারা প্রায় সবাই ‘মেডিক্যাল লিভ’-এ, দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে চনমনে ইংল্যান্ডের মহড়ায় নামতে হচ্ছে হোয়াইটওয়াশের ঘা শুকনোর আগেই। চোট লাগা হাত নিয়ে টানা খেলে যাওয়ায় কিপিংয়ের বারোটা বেজেছে, ইংল্যান্ডে সবাই দেখছে। রইল বাকি ব্যাটিং। গোটা দুয়েক ম্যাচ জেতানো ইনিংস এই সিরিজে ক্যাপ্টেনের এক্ষুনি দরকার। না পারলে ওয়াংখেড়ের বিশ্বকাপ ফাইনালের ফ্ল্যাশব্যাক ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসবে। এই টিম নিয়ে জিতে গেলে ভাল, সমালোচনার ঝাঁপ সাময়িক বন্ধ থাকবে। কিন্তু হারলে এবং নিজে ব্যাটিংয়ে তেমন কিছু করতে না পারলে ‘ধোনি হঠাও’ আওয়াজ উঠল বলে। যেটা নিশ্চিত কোলাহলে রূপ নেবে বছর শেষে অস্ট্রেলিয়া সফরে বিপর্যয় ঘটলে।
ধোনির বিপক্ষ শিবির প্রত্যাশা মতোই টগবগিয়ে আছে। অ্যালিস্টার কুক যা বলে গেলেন, তাতে পরিষ্কার, মাসখানেক আগে ভারতকে দুমড়ে দেওয়ার সুখস্মৃতি যাতে আত্মতুষ্টির আকার না নেয়, সেটাই আপাতত টিমের পাখির চোখ। “আমরা দেশে জিতেছি। এখানেও চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছি। আমরা জানি গত এক দশকে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া কেউ এ দেশে ওয়ান ডে সিরিজ জিতে ফেরেনি। আমরা ইতিহাসটা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।” অ্যান্ডারসন বিশ্রামে, ব্রড চোট পেয়ে বাইরে। পেস আক্রমণের জোড়া ফলার অভাব নিয়ে তেমন চিন্তিত লাগছে না অতিথিদের। দীর্ঘকায় স্টিভন ফিন আর ডার্নব্যাচে আস্থা রাখছে তারা, সঙ্গে ব্রেসনান আর স্পিনের নেতৃত্বে সোয়ান।
ভারতের মাটিতে নড়বড়ে ভারতকে পেড়ে ফেলার মোক্ষম সুযোগ সামনে। আর সেটা পারলে ‘পাড়ায় মেরেছি, বেপাড়ায়ও পেরেছি’ ব্রিটিশ-হুঙ্কার ক্রিকেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। আর না পারলে নিন্দুকেরা বলবে ভারতের আর দোষ কী? এরাও তো নিজের পাড়াতেই কেবল হিরো!
কী দাঁড়াল তা হলে? বদলার নয়, বদলের সিরিজ। নিয়মে বদল, দু’দিক থেকে এই প্রথম আলাদা নতুন বল। রানার নেওয়ার সুযোগ না থাকা। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে নেওয়ার সময়সীমা ওভার অনুযায়ী বেঁধে দেওয়া। যুযুধান দু’দলের কাছে এ তো বদলেরই সিরিজ। বিশ্বসেরার মুকুট অদূর ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা দূর অস্ত, এই যে ধারণাটা ক্রিকেটবিশ্বে শিকড় গেড়ে বসেছে, কলঙ্কিত ইংল্যান্ড সফরের পর, সেটা যথাসাধ্য বদলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ধোনিদের কাছে। জাহিরের যোগ্য বিকল্প পেতে মঙ্গলগ্রহে লোক পাঠানো দরকার বোর্ডের, এই প্রচলিত মতটা বদলে দেওয়ার সুযোগ উমেশ যাদব, বিনয় কুমারদের সামনে। ভারতের স্পিনের সাঁড়াশি এখনও সেই ভাজ্জির হাতেই সবচেয়ে ভাল মানায়, এই ধ্যানধারণা পাল্টে ফেলার এত ভাল মঞ্চ আর পাবেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন? সাধে ধোনি প্র্যাক্টিসে তাঁকে নিয়ে পড়ে রইলেন?
সিরিজের ক্যাচলাইন তা হলে কী হওয়া উচিত? খুব সোজা। ওই চারটে শব্দের বাক্যবন্ধ, যেটা পশ্চিমবাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে নিয়ম করে ব্যবহার করতেন।
‘বদলা নয়, বদল চাই!’




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.