শব্দবাজির মোকাবিলায় এ বছর সক্রিয় ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সচেতনতা কর্মসূচির উপরেই জোর দিচ্ছে রাজ্য পরিবেশ দফতর।
এক দিকে আতসবাজির শব্দমাত্রা ৯০ ডেসিবেল থেকে বাড়িয়ে ১২৫ ডেসিবেল করার জন্য রাজ্য সরকারের উপরে চাপ, অন্য দিকে হাইকোর্ট নিয়োজিত চার স্পেশাল অফিসারের অনুপস্থিতি কালীপুজোর মুখে যেন হঠাৎই দিশাহারা অবস্থা রাজ্য পরিবেশ দফতর এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। যদিও কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে হাতিয়ার করে গত কয়েক বছর ধরে শব্দবাজির তাণ্ডবের মোকাবিলা চলছে কড়া হাতে। তাতে ফলও ফলেছে।
নিষিদ্ধ শব্দবাজির উপরে নজরদারির কাজ হয় মূলত স্টেট নয়েজ মনিটরিং কমিটির তত্ত্বাবধানে। কমিটির আহ্বায়ক পর্ষদের চিফ ল’ অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি এখন লম্বা ছুটিতে। অন্য দিকে, গরহাজির হাইকোর্ট নিয়োজিত স্পেশাল অফিসারেরাও। প্রবীণ আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার তপনকুমার বর্মণ এবং ইএনটি চিকিৎসক আবিরলাল মুখোপাধ্যায় বয়সের কারণে অব্যাহতি নিয়েছেন। ফলে তাঁরা যে কাজগুলো করতেন, তা-ও বন্ধ হয়ে রয়েছে। এমন এক সময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যানও বিনয় দত্ত বেড়িয়েছেন বিদেশভ্রমণে। গীতানাথবাবু বলেন, “এখন শব্দবাজির বিরুদ্ধে রাজ্যে আইন আছে। মোকাবিলা করা অনেক সুবিধাজনক। কিন্তু আমি মনে করি ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী না-হলে এ সব বিধি পুরোমাত্রায় কার্যকর করা সম্ভব নয়। আমরা যা করেছি ব্যক্তিগত উদ্যোগেই।”
পশ্চিমবঙ্গই একমাত্র রাজ্য যেখানে ৯০ ডেসিবেলের উপরে শব্দবাজি উৎপাদন, মজুত, আমদানি, বিক্রি বা ব্যবহার নিষিদ্ধ। ফলে এই বিধি কার্যকর করা রীতিমতো কঠিন। কারণ শিবকাশীর মতো বৃহত্তম বাজি উৎপাদক ছাড়াও ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড বা বিহার থেকে চোরাপথে অবৈধ শব্দবাজি রাজ্যে ঢোকে। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় মজুত করা হয়। সেগুলোই কালীপুজোর সময় বাজারে আসে। গত কয়েক বছরে বরাবরই জুন-জুলাই মাস থেকে চম্পাহাটি, নীলগঞ্জ, নৈহাটি বা ডানকুনির মতো বাজি তৈরির কেন্দ্রগুলোতে অবৈধ শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করার অভিযান চালানো হত। ওই সব জায়গায় অনেকেই ৯০ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী শব্দবাজি তৈরি করেন অবৈধ ভাবে। ফি-বছর অভিযানের সময়ে প্রচুর চকোলেট বোমা বাজেয়াপ্ত করা হত। তা ছাড়া, শিবকাশী থেকে অবৈধ শব্দবাজি যাতে রাজ্যে না আসে, তার জন্যও সেখানকার বাজি উৎপাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন পর্ষদের আধিকারিকেরা।
গীতানাথবাবু বক্তব্য, পুলিশ আরও তৎপর না হলে নিষিদ্ধ শব্দবাজির তাণ্ডব কোনও ভাবেই আটকানো যাবে না। পরিবেশসচিব রাজ সিংহ কাহালো বলেন, “কলকাতা পুলিশ এবং রাজ্য পুলিশকে বলা হয়েছে অবৈধ বাজির ব্যবসা কড়া হাতে দমন করতে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতে আমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে নিয়ে আলোচনাসভার আয়োজন করছি। আগামী ১৮ অক্টোবর টাউন হলে সেই সভায় বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তা ছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি হিসেবে ২৩ অক্টোবর কলকাতায় বড় প্রচার-মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে।”
পাশাপাশি, বাজির শব্দমাত্রা ৯০ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ ডেসিবেল করতে শাসক-বিরোধী দুই তরফই সরকারের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে। গত কয়েক বছরে সিপিএম নেতারা এই মাত্রা বাড়াতে চেষ্টা করেছেন। এ বছর তৃণমূল বিধায়ক নিখিলচন্দ্র মণ্ডল রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে শব্দবাজির মাত্রা ১২৫ ডেসিবেল করার দাবি জানিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, রাজ্য শব্দবাজির মাত্রা ৯০ ডেসিবেলে বেঁধে দেওয়ায় মার খাচ্ছে বাণিজ্য। কিন্তু সেই আবেদনে এই বছরও সাড়া দেয়নি সরকার। পরিবেশসচিব বলেন, “বাজির শব্দমাত্রা বাড়ানোর আবেদন আমরা বাতিল করে দিয়েছি।”
অনিশ্চিত বাজি বাজার। বৃহস্পতিবার শিল্পমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের সঙ্গে দেখা করার পরেও বাজি-বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটল না। এ বছর ময়দানে বাজি বাজারের অনুমতি দেয়নি সেনা। ফোর্ট উইলিয়মের কর্তারা জানিয়েছিলেন, এ ধরনের বাণিজ্যিক বাজারের জন্য দিল্লির সদর দফতরের অনুমতি প্রয়োজন। তার পরে বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও অনুমতি মেলেনি। তাই এ দিন মহাকরণে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সঙ্গে দেখা করেন বাজি ব্যবসায়ীরা। বড়বাজারের বাজি ব্যবসায়ী সংগঠনের সম্পাদক সঞ্জয়কুমার দত্ত জানান, মুখ্যসচিব বিষয়টি নিয়ে দিল্লিতে কথা বলবেন। তাঁরা কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দার সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও দাবি সঞ্জয়বাবুদের। এ বছর সেনার অনুমতি না মিললে কি বাজি বাজার বসবে না?
সঞ্জয়বাবু জানিয়েছেন, আজ, শুক্রবার লালবাজারে পুলিশ, দমকল-সহ সরকারি দফতরগুলির সঙ্গে বাজি ব্যবসায়ীদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তার পরেই বিকল্প জায়গার কথা জানানো হতে পারে। |