সংখ্যার হিসাবে উর্ধ্বসীমা তিনশত অতিক্রম করিবে না, ন্যূনপক্ষে আন্দাজ একশত। মায়ানমারে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দিদের সংখ্যার হিসাব লইয়া এমনই সব জল্পনা বাতাসে ভাসিতেছে। প্রত্যাশা যে মাত্রায় ছিল, মুক্তিদানের হিসাব তাহা স্পর্শ করে নাই। মানবাধিকার কর্মীগণ বলিতেছেন, অতি অল্প হইল। তাঁহাদের খতিয়ান অনুযায়ী অন্তত দুই সহস্র ব্যক্তি রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে কারান্তরালে রুদ্ধ। সেই দেশের ফৌজি শাসন অজস্র রাজনৈতিক বন্দির কারাবাসের মেয়াদ শতাধিক বৎসর করিয়া ধার্য করিয়াছে, সুতরাং জীবদ্দশায় মুক্তি পাইবার আশা নাই বলিলেই চলে। এই পরিস্থিতিতে যদি তিনশো ব্যক্তিও মুক্তি লাভ করেন, তাহাকে মানবাধিকার কর্মীগণ বিশেষ গুরুত্ব প্রদানে নারাজ। একে তো মুক্তিপ্রাপ্ত ছয় সহস্রের কিছু বেশি বন্দির ভিতর সর্বোচ্চ আন্দাজ অনুযায়ী মাত্র তিনশত কারা-প্রাচীরের বাহিরে আসিয়াছেন। অনুপাতটি কার্যত নগণ্য। দ্বিতীয়ত, দেশের অধিকাংশ প্রথম সারির রাজনৈতিক এবং মানবাধিকার কর্মীই এখনও কারান্তরালে। সুতরাং, সরকারের যে সত্যই সদিচ্ছা আছে, তাহা বুঝাইবার জন্য আরও অনেক বন্দির মুক্তি প্রয়োজন ছিল বলিয়া মানবাধিকার সংস্থাগুলির মত। পাশাপাশি, মায়ানমারের বিরোধী নেত্রী আউং সান সু চি এই পদক্ষেপকে খুবই সতর্ক ভাবে স্বাগত জানাইয়াছেন। প্রতিটি বন্দির মুক্তিলাভই অতীব বাঞ্ছিত, এই বার্তা দিবার সহিত তিনি জানাইয়াছেন, তাঁহার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী একশতের মতো রাজনৈতিক বন্দি ছাড়া পাইয়াছেন, এবং সেই মুক্তির জন্য তিনি সরকারকে ধন্যবাদ দিয়াছেন। পাশাপাশি, ইহাও জানাতে ভুলেন নাই যে, আরও অনেক কাজ বাকি, সরকার যদি গণতান্ত্রিক ভাবধারাকে সত্যই সম্মান জানাইতে চাহে, তাহা হইলে আরও অনেক মুক্তিদান প্রয়োজন।
মায়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি লইয়া এই দুইটি প্রতিক্রিয়ার ভিতরেই অবস্থার সারাৎসারটি নিহিত। দুই দিক হইতে দুইটি তরফেই কিছু সত্য নিহিত। মুক্তিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দিদের সংখ্যা সত্যই এমন কিছু নহে যে তাহাতে উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করা চলে। বিশেষত, এখনও এত বন্দি মুক্তির অপেক্ষায় যে সেই তুলনায় এমনকী তিনশত সংখ্যাটিকেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া মনে হয় না। অন্য দিকে, গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাক্রম প্রমাণ করিতেছে যে, কিছু হইলেও বরফ গলা শুরু হইয়াছে। যে দেশের সরকার একদা রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে জনৈক জনপ্রিয় কৌতুকাভিনেতাকেও গ্রেফতার করিতে ছাড়িত না, সেই সরকারই যদি বিরোধী পক্ষের সহিত সংলাপের উদ্যোগে সাড়া দেয়, তাহা নিশ্চিত ভাবেই কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। অতঃপর, সেই পরিবর্তন কোন দিকে যাইবে, কত দূর সদর্থক বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে, তাহা ভবিষ্যতের ব্যাপার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন সঙ্গত কারণেই জানাইয়াছেন, গণতন্ত্রীকরণের অভিমুখে এই সরকারি উদ্যোগ স্বাগত, কিন্তু এখনই ইহার প্রতিক্রিয়ায় কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের সময় আসে নাই। তিনিও সু চি-র ন্যায় একটি সতর্ক আশাবাদ জ্ঞাপন করিয়াছেন। যদিও আন্তর্জাতিক কূটনীতির একাংশের মতে, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে মায়ানমারে ফৌজি অভ্যুত্থানের পরে সাম্প্রতিক কয়েকটি সপ্তাহের কার্যক্রমই সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু অনেকেই খুব সাবধানতার সহিত বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করিবার পক্ষপাতী। একটি উদ্যোগ শুরু হইয়াছে। অতঃপর মায়ানমার সরকারকেই স্থির করিতে হইবে, তাঁহারা দেশকে ঠিক কোন পথে লইয়া যাইতে চাহেন। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিবার দায়ে মায়ানমার আন্তর্জাতিক মহলে কার্যত একঘরে অবস্থায় পতিত। সেই দশা কাটাইতে হইলে গণতন্ত্রের পুনঃস্থাপন প্রয়োজন। সরকার অবস্থা পরিবর্তনের একটি আভাস দিয়াছে। আভাসমাত্র। |