সলমন খুরশিদের সাম্প্রতিক বিতর্কিত বক্তব্যটি লইয়া আলোচনার আগে একটি গোড়ার কথা বুঝিয়া লওয়া দরকার। তাহা হইল, খুরশিদের কথার উপরিতলের বক্তব্য এক, কথার অন্তস্তলের বক্তব্য অন্য। এবং ভিতরের বক্তব্যটিই এ ক্ষেত্রে বিচার্য। বেণীর চুলচেরা বিশ্নেষণের বদলে বেণীর সঙ্গে যে মাথাটি রহিয়াছে, তাহার উপরই আলোকপাত জরুরি। খুরশিদ এমনিতেই বিচক্ষণ রাজনীতিক, তাহার উপর বিচারবিভাগের সমালোচনা করিতে বসিয়া তিনি যে বিশেষ রকম সাবধানতা লইবেন, যেটুকু বলিবেন তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি কিছু না বলিয়া বলিবেন, তাহা বুঝিতে বেগ পাইতে হয় না। তিনি বলিয়াছেন, এই ভাবে দেশের শিল্পপতিদের জেলে আটক করিলে দেশে কি আর বিনিয়োগ আসিবে? এই প্রশ্নের অন্তরালে আসলে আরও বড় একটি প্রশ্ন নিহিত। সম্প্রতি টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির জেরে জেলে আটক বহু শিল্পপতির বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও সন্দেহের বশেই ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে, এবং সেই সব সন্দেহ মিথ্যা না-ই হইতে পারে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশে কোনও ব্যক্তিকে কি এ ভাবে বিনা বিচারে আটক রাখা যুক্তিযুক্ত? সন্দেহের উপর ভিত্তি করিয়া কাহারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনীত হইতে পারে, কিন্তু সেই অভিযোগ প্রমাণিত হইবার আগে তাঁহাকে আটক করা অর্থাৎ শাস্তি দান করা কি উচিত? হেবিয়াস কর্পাস নামক যে নীতির উপর ভিত্তি করিয়া ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার স্বীকৃত, তাহার এ হেন দলন ঘটিলে উদারনৈতিক অর্থনীতি কোন গণতন্ত্রের আশা ও ভরসায় এ দেশে বিকশিত হইবে? অর্থাৎ সলমন খুরশিদ যে বিতর্ক উঠাইয়াছেন, তাহা কেবল শিল্পপতিদের সম্পর্কে দুশ্চিন্তাটুকুই ব্যক্ত করে না, বড় পরিসরে ভারতীয় গণতন্ত্রের চৌহদ্দিতে ব্যক্তি-অধিকারের নিয়মিত লঙ্ঘনের বিষয়টির উপরও আলোকপাত করে।
ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যথেষ্ট ক্ষিপ্রতার সহিত আইনমন্ত্রীর মন্তব্যে দ্বিমত ব্যক্ত করিয়াছে। কেবল দ্বিমত নয়, ক্ষোভও। ক্ষোভের কারণটি ঠিক কী, তাহা যথেষ্ট স্পষ্ট নহে, কারণ আপাতভাবে আইনমন্ত্রীর উক্তিতে আদালত সম্পর্কে কোনও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায় নাই। তবে, দ্বিমত থাকিতেই পারে। বিচারের যুক্তিটিও নিশ্চয়ই গুরুতর। ভারতীয় বাস্তবে, অপরাধী সর্ব ক্ষেত্রেই প্রমাণ বিলোপের প্রবল প্রয়াস করিবে, এবং বহু ক্ষেত্রেই তাহাতে সফল হইবে, এই মনে করিয়াই সন্দেহভাজনদের অন্তরিন রাখা হয়। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। যদি বা এই আশঙ্কা সত্যও হয়, তাহা হইলেও কি মৌলিক অধিকারের দলন সমর্থন করা যায়? দুইটি ভুল মিলিয়া যেমন ‘ঠিক’টি রচনা হয় না, তেমনই এক অন্যায় রুখিবার জন্য বিচারের নামে আর এক ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যায় কি?
গণতান্ত্রিক বিচারে যে কোনও অভিযুক্তের পক্ষে জামিন একেবারে সাধারণ পন্থা হওয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের মতো দেশে নিয়মমাফিক সকল অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া হয়, অত্যন্ত বিশেষ কিছু ক্ষেত্র বাদ দিয়া। এবং সেখানেও, কেন সেই ক্ষেত্রগুলি অত্যন্ত বিশেষ, তাহা স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করিবার দায় বিচারবিভাগেরই। এই ধরনের মৌলিক নীতি কিংবা রীতি হইতে বিচ্যুত হওয়া খুবই বিপজ্জনক। তাহাতে গণতন্ত্রের মূল মন্ত্রটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষয়টি আপাতত শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে যাইতেছে বলিয়া সাধারণ্যের হর্ষোৎফুল্ল হইবার কারণ নাই। যে কোনও দিন এই অ-গণতন্ত্র যে কোনও ক্ষেত্রে যে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে যাইতে পারে। সুতরাং গণতন্ত্রের ভিত্তিটি যাহাতে বিপন্ন না হয়, তাহা দেখা দরকার। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সেই ভিত্তি লইয়া সাংসদ, রাজনীতিক, বিচারপতিগণের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্কের সূচনা হইল, ইহাই সুখবর। |