সরকারি হাসপাতালে পরিদর্শনে আসা জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করলে এ বার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীর জরিমানা হবে। বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনেই এই সংক্রান্ত বিল আনতে চলেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রভিশন ফর বেসিক হেল্থ সার্ভিসেস বিল ২০১১’ নামে ওই বিলের খসড়া ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। তার সাত নম্বর ধারায় বলা আছে, যদি রোগীদের স্বার্থে কোনও জনপ্রতিনিধি কোনও সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শনে যান, এবং কোনও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মী তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান (ডিউ কার্টসি) না-দেখান, তা হলে সেটি ‘মিসকনডাক্ট’ বা অসদাচরণ হিসাবে গণ্য হবে। যার জন্য ওই জনপ্রতিনিধি মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ জানাতে পারেন। দোষ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীর ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। জরিমানার টাকা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার ক’দিন বাদেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আচমকা ‘বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি’ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, তখন প্রতিষ্ঠানের তদানীন্তন অধিকর্তা শ্যামাপদ গড়াই তাঁর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। শ্যামাপদবাবুকে সাসপেন্ড করে কারণ দর্শাতে বলা হয়। আর তার রেশ না-কাটতেই এই বিলের তোড়জোড়। যার ব্যাখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা বলেছেন, রোগীকল্যাণ সমিতি, পরিবারকল্যাণ সমিতি কিংবা হেল্থ অ্যান্ড স্যানিটেশন কমিটির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বভাবতই স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক, সাংসদেরা ঘন ঘন হাসপাতালে আসবেন। তাঁরা চাইলে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে হবে। না-করলে সেটাকে দুর্ব্যবহার বা অসম্মানজনক ব্যবহার হিসেবেই ধরা হবে।
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: হাসপাতাল পরিদর্শনরত জনপ্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় তথ্য না-জানালে আগে বিভাগীয় তদন্ত হত। কিন্তু সেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। স্বাস্থ্য দফতর আরও দ্রুত শাস্তি চাইছে বলেই জরিমানার কথা ভাবা হয়েছে। এতে সমালোচনার পথও খোলা থাকছে। যার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য-সচিব সঞ্জয় মিত্র বলছেন, “জনপ্রতিনিধিরা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কাছে কতটা তথ্য চাইলে তা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পর্যায়ে পড়বে, তা তর্কসাপেক্ষ। বিষয়টিকে সকলের সামনে রেখেছি। আলোচনা হোক।”
কিন্তু ‘ডিউ রেসপেক্ট’ বা যথাযথ সম্মানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করবে কে? প্রশ্নটা বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে। বামপন্থী চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিসেস ডক্টরস’-এর তরফে যেমন বলা হয়েছে, “সম্মান বা রেসপেক্ট ব্যাপারটাই তো আপেক্ষিক! এক জন যেটাকে ‘অসম্মানজনক’ মনে করছেন, আর এক জন তেমন না-ও ভাবতে পারেন।” স্বাস্থ্য-কর্তাদের বক্তব্য, যোগ্য বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের হাতেই তদন্তের ভার দেওয়া হবে।
তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
বাম আমল থেকে শুরু করে হালের ‘পরিবর্তনের’ জমানাতেও বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গোলমালের ঘটনায় জনপ্রতিনিধিদের নাম জড়িয়েছে। চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীদের অভিযোগ: ওই জাতীয় পরিস্থিতিতে তাঁরা সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিকে পাল্টা দু’-চার কথা বললেই তাকে ‘মিসকনডাক্ট’ হিসেবে ধরা হয়। ফলে কাজ করাই মুশকিল হচ্ছে। তাই চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীদের অনেকেই বলছেন, হাসপাতালে গোলমাল বাধালে জনপ্রতিনিধির শাস্তির সংস্থানও আইনে থাকুক। নচেৎ সরকারের আসল উদ্দেশ্যটাই মাটি হবে। |