চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষায় দেশের চালচিত্র এই মুহুর্তে খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। এই বদলানো চিত্রে আরও দোলা লেগেছে কেন্দ্রীয় সরকার ও মেডিক্যাল কাউন্সিলের একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে। দেশের সমস্ত চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য এখন থেকে এক এবং অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে। চিকিৎসা-শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং দেশ জোড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানান প্রতিষ্ঠানের গুণমানে যাতে সমতা এবং উৎকর্ষ আসে, তাই এই সিদ্ধান্ত। এক দিকে চিকিৎসকরা উন্নত গুণমানের হোন এই চিন্তাটি চিত্তাকর্ষক। অন্য দিকে চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রে ‘প্রবেশাধিকারে’ এ রকম প্রয়াস আমাদের দেশে আদৌ ফলদায়ী হবে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের রাজ্যের সরকার-সহ বেশ কিছু রাজ্য সরকার এ ক্ষেত্রে রাজ্যের ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আসন সংরক্ষণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের প্রশ্নে সরব। উদ্যোগটির যৌক্তিকতা এবং তার ফলে দেশে কী পরিবর্তন আসতে পারে, তা বিবেচনা করা দরকার। বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব প্রবেশিকা আছে, তা ছাড়াও একটি কেন্দ্রীয় প্রবেশিকার মাধ্যমে ১৫ শতাংশ ছাত্র নির্বাচিত হন যাঁরা দেশের যে কোনও অংশে পড়তে পারেন। আলোচ্য উদ্যোগে, এই শতাংশের হারের পরিবর্তন না হলেও, যা হবে তা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা যা রাজ্যের প্রচলিত সিলেবাস অনুযায়ী তার বদলে দেশজোড়া একটিই পরীক্ষা হবে। হঠাৎ এসে পড়া নতুন সিলেবাস ছাড়াও বিশাল এই দেশে আঞ্চলিক ভাষায় পরীক্ষা দেওয়াটাও ছাত্রদের চিন্তার প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখনও নিশ্চিত নয় আঞ্চলিক ভাষায় পরীক্ষা দেওয়া যাবে কি না।
এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার প্রশ্ন এ জন্যই উঠছে যে, অসম বিকাশের ধারা বেয়ে এ দেশে যেখানে ৩৬ শতাংশ মানুষের বাস সেই বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে মাত্র ১৫ শতাংশ চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। অন্য দিকে দেশের ৩১ শতাংশ মানুষের আবাস দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে আছে ৫৮ শতাংশ আসন। স্বাধীনতার পর থেকে চিকিৎসা শিক্ষায় বেসরকারি এবং ব্যবসায়িক অংশগ্রহণ ক্রমাগত বেড়েছে। এই মুহূর্তে দেশের ৫৭ শতাংশ মেডিক্যাল কলেজ ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে পরিচালিত। আগামীতে তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা। যে চিত্রটা পরিষ্কার, তা হচ্ছে এ দেশের চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকাশ যতটা না মানুষের প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে হয়েছে, তার থেকে বেশি হয়েছে ‘চিকিৎসা-শিক্ষা’কে শিল্প হিসেবে বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে। বহু আলোচিত স্বাস্থ্যে গ্রাম-শহরের প্রভেদ তো আমাদের স্বাধীনতার সময়ের উত্তরাধিকার। এই মুহূর্তে দেশের শহরাঞ্চলে প্রতি দশ হাজার মানুষে চিকিৎসকের অনুপাত ১৩.৯, যেখানে গ্রামাঞ্চলে সেটা ৩.৩। চিকিৎসকরা হচ্ছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট মানব সম্পদের প্রাণভোমরা। মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নগুলি নাড়া দিচ্ছে, তার অন্যতম হচ্ছে গুণগত উৎকর্ষবৃদ্ধিকে পাখির চোখ করে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে যে আঞ্চলিক বৈষম্য এখনই আছে, তাকে আরও প্রকট করবে না তো? ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’-এর প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে দেশের অগণিত মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর পরিকল্পনায় ঘাটতি পড়বে না তো? এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত? খণ্ডিত উন্নয়নের উত্তরাধিকারী আমরা সবাই এ দেশে। তারই ফলশ্রুতিতে পড়াশোনার সুযোগসুবিধা এবং প্রকরণে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিস্তর তারতম্য আছে। ‘মেধাকে’ একমাত্র এবং অনির্বচনীয় সত্য বলে মেনে নিয়ে তৈরি এই উদ্যোগে কোথাও মেধার ‘বিকাশ ও পরিচর্যায়’ ‘সুযোগের’ ভূমিকা স্বীকৃত নয়। ফলে, স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রয়াস এ দেশে ‘সুবিচারের অভাব’ এবং ‘বঞ্চনার’ স্বতঃসলিলা লম্বা ফর্দটাকে আরও বহমান করবে না তো? এর সঙ্গে উঠে আসছে আরও একটি মূলগত দার্শনিক প্রশ্ন আপাতদৃষ্টিতে জটিল হলেও যা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। চিকিৎসার মতো সমাজসম্পৃক্ত, মননশীল পেশার প্রবেশাধিকারে মেধার মানদণ্ডের যান্ত্রিক কুঠারাঘাত ‘গুণগত উৎকর্ষ’ নামের সোনার হরিণের সন্ধান আদৌ দেবে কি?
চিকিৎসক হতে গেলে ভাল ছাত্র হতে হবে, এতে কোনও দ্বিমত নেই। প্রশ্নটা হচ্ছে, একমাত্র মেধাবী ছাত্ররাই ‘উন্নত’ চিকিৎসক হবেন, এই তথ্য এবং তত্ত্ব ধোপে টেকেনি। ধীশক্তিতে ভর করে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রকে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংশ্লেষ করতে হয়, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রটা আরও অনেক বিস্তৃত। সেখানে ভরসা করতে হয় বিজ্ঞানের দেওয়া অন্তর্দৃষ্টি, সহজাত মননশীলতা এবং সমাজবোধের ওপর। তত্ত্বের যান্ত্রিক প্রয়োগে রোগ সারে না। প্রায়ই দেখা যায়, মেধার ভারে ন্যুব্জ চিকিৎসকের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন চিকিৎসকের মরমি স্পর্শ বেশি সমাদর লাভ করছে। কথাটা হল, অভিন্ন পরীক্ষার সামনে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের ফেলে দেওয়ার আগে একটা প্রস্তুতি পর্বের বন্দোবস্ত করা যেত না কি?
পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা কিছু ছাত্রের ওপর বহু পরীক্ষার বোঝা কমতে পারে হয়তো, কিন্তু তার চেয়ে শতগুণ বেশি সংখ্যক ছাত্রের একমাত্র স্বপ্ন ‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স’ তো তার অভিঘাতে লোপ পাচ্ছে। দেশজোড়া অভিন্ন প্রবেশিকায় উত্তীর্ণ ছাত্রেরা ধীশক্তিতে বলীয়ান হবেন, উন্নত, যন্ত্রশোভিত চিকিৎসা ব্যবসায়ের উপযুক্ত মানবসম্পদ হিসাবে তৈরি হবেন, কিন্তু কালাহান্ডি, বেলপাহাড়ি, কোরাপুট-এর মতো প্রান্তিক এলাকার মানুষদের জন্যেও তো চিকিৎসক দরকার। তার কী হবে? ‘মেধা’ অবশ্যই থাক, কিন্তু মেধাসর্বস্বতা ঔদ্ধত্য ও সমাজবিমুখতার জন্ম দিতে পারে। প্রয়োজন হৃদয় এবং মস্তিষ্কের যুগলবন্দি। অভিন্ন প্রবেশিকা তার দরজা খুলবে তো?
লেখক চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এ শিক্ষক |