জেঠামহাশয়ের খবরদারি অব্যাহত রহিল। দৈনিক কতগুলি টেক্সট মেসেজ করা চলিবে, ট্রাই তাহা বাঁধিয়া দিবার পরে পক্ষকালও সময় কাটে নাই, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক টেলিভিশন চ্যানেলগুলির জন্য নূতন নিয়মের ফিরিস্তি পেশ করিল। ‘প্রোগ্রাম অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং কোড’ নামক নিয়মবিধিটি বিপুল। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপনে কী কী দেখানো চলিবে না, মন্ত্রক তাহা নির্ধারণ করিয়া দিল। অতঃপর, কোনও চ্যানেল পাঁচ বার এই নিয়ম অমান্য করিলে সেই চ্যানেলের লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের না করিবার সম্পূর্ণ অধিকার সরকারের থাকিবে। আরব দুনিয়ার কোনও দেশে বা চিন, সিঙ্গাপুরে এই নিয়ম চালু হইলে বিস্ময়ের কারণ থাকিত না। কারণ, এই দেশগুলি গণতন্ত্র লইয়া অষ্ট প্রহর ঢাক বাজায় না। কিন্তু, জনসংখ্যার জোরে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হইয়া যে দেশের আহ্লাদের অন্ত নাই, সেই দেশের শাসককুলের জেঠামহাশয়-পনায় যদি যতি না থাকে, তাহা হইলে বোঝা যায় গণতন্ত্রের গুণকীর্তনটি কণ্ঠ হইতে হৃদয়ে উত্তীর্ণ হয় নাই। তাহা যে হয় নাই, এই কথাটি প্রমাণ করিতে ভারতীয় নেতারা কখনও কসুর করেন নাই। স্বাধীনতা-পরবর্তী নেহরু যুগে যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভ্যাসটি আরম্ভ হইয়াছিল, নেহরু-যুগের অবসানের বহু পরেও সেই অভ্যাসটি মরে নাই। কর্তারা স্থির জানিয়াছেন, নাগরিক মাত্রেই নাবালক। কাঁচা ছেলেকে সামলাইয়া রাখা, শাসন করা, ভাল-মন্দ বুঝাইয়া দেওয়া জেঠামহাশয়ের কর্তব্য। কর্তারা অন্য দায়িত্ব যতই ভুলুন, নাবালক নাগরিকদের সৎ পথে পরিচালনা করিবার দায়িত্বটু মুহূর্তকাল ভুলেন নাই। ছোট ছেলে বখিয়া যাইবে, এখন সেই ভয়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সীমা বাঁধিয়া দিতে আসরে নামিয়াছেন। ভারতে, ছোট-বড় খুঁত সমেত, গণতন্ত্র এখনও বাঁচিয়া আছে। তাহার মর্যাদা রক্ষাও অতএব, কর্তব্যের তালিকায় পড়ে। নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা তাহার একটি অঙ্গাঙ্গি ধাপ। দেশে আইন আছে। কোনও টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান যদি সেই আইন লঙ্ঘন করে, তবে অবশ্যই সেই চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করিতে হইবে। আইন অনুসারেই। কিন্তু, অনুষ্ঠান যদি আইনের পরিপন্থী না হয়, তবে সরকারের কিছু করণীয় নাই। সরকার রুচির রক্ষক নহে, সমাজের নৈতিক অভিভাবকও নহে। কোন অনুষ্ঠান জনরুচিকে আহত করিবে, জাতীয় আবেগে আঘাত করিবে তাহা নির্ধারণ করিয়া দেওয়া সরকারের কাজ নহে। মানুষ কোন অনুষ্ঠান দেখিবেন, কোন অনুষ্ঠানকে প্রত্যাখ্যান করিবেন সেই সিদ্ধান্ত মানুষের হাতে থাকাই বাঞ্ছনীয়। জেঠামহাশয় বিস্মিত হইতে পারেন, কিন্তু তাঁহার জানা প্রয়োজন যে গ্রহণ-প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত মানুষ যথেষ্ট দক্ষ ভাবে করিতে পারেন। টেলিভিশনের ক্ষেত্রে আরও একটি কষ্টিপাথর রহিয়াছে। তাহার নাম বাজার। টেলিভিশন সম্পূর্ণ ভাবেই বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল। এবং, বিজ্ঞাপনের গতি নির্ধারিত হয় মানুষের চাহিদা অনুসারে। কোনও অনুষ্ঠান যদি মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়, তবে তাহার বিজ্ঞাপন জুটিবে না। আর, সূর্যালোকের অভাবে গাছ বাঁচিতেও পারে, বিজ্ঞাপনের অভাবে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মৃত্যু নিশ্চিত। রুচিসম্মত নহে, এমন অনুষ্ঠানের মৃত্যু যখন বাজারের হাতেই নিশ্চিত, তখন তাহার মধ্যে সরকারের নাক গলাইবার প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর নাই। কিন্তু, জেঠামহাশয়ের জেঠাগিরিতেই আনন্দ। সরকারের গতিবিধি দেখিয়া আশঙ্কা হয়, অদূর ভবিষ্যতে এই কু-অভ্যাসটি নির্মূল হইবার কোনও সম্ভাবনা নাই। গণতন্ত্র লইয়া ঢক্কানিনাদ চলিবে, বাজারের জয়গান চলিবে, তাহার পাশাপাশি জেঠাগিরিও চলিবে। ইহাকেই সম্ভবত ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা’ বলা হইয়া থাকে। |