সামাজিক এবং রাজনৈতিকের মধ্যে পার্থক্য কোথায় এবং কতখানি? অণ্ণা হাজারে-কে লইয়া সম্প্রতিকালে যে সব প্রশ্ন উঠিতেছে, তাহার মূলে রহিয়া যায় একটি গোলমেলে অভিমত। সেই অভিমত অনুসারে, সামাজিক সক্রিয়তা ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা বস্তু দুইটি সর্বৈব আলাদা, তাহারা একই সময়ে একই ক্ষেত্রে অবস্থান করিতে পারে না। সম্প্রতি কংগ্রেস নেতারা অভিযোগ তুলিয়াছেন, অণ্ণা হাজারে এত দিন নিজেকে সামাজিক কর্মী হিসাবে পরিচয় দিয়াছেন, তাঁহার আন্দোলনকে সামাজিক সচেতনতার আন্দোলন বলিয়া দাবি করিয়াছেন, অথচ সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম প্রমাণ করে যে তাঁহার রাজনৈতিক সক্রিয়তা বিলক্ষণ উপস্থিত, তিনি বিরোধী দলের রাজনীতির সহিত প্রত্যক্ষত ও পরোক্ষত সংযুক্ত, এমনকী তাঁহার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উচ্চাশাও যথেষ্ট। হাজারের এই রাজনৈতিক সত্তার আবিষ্কার নাকি তাঁহার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার মূল ভিতটিকেই নাড়াইয়া দিতেছে, বলিতেছে কংগ্রেস। এখন বুঝা যাইতেছে, কেন কী লক্ষ্য লইয়া তিনি লোকপাল বিল-এর আন্দোলনে নামিয়াছিলেন, বুঝা যাইতেছে যে গাঁধীজীর সঙ্গে তিনি নিজের যত তুলনাই টানুন, তাঁহার কার্যক্রমে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা যেহেতু ব্যক্তিগত স্বার্থশূন্য নহে, তাই গাঁধীর সহিত অণ্ণাও কোনওমতেই তুলনীয় নহেন।
প্রশ্ন উঠিবে, কোনটা সামাজিক আন্দোলন আর কোনটা রাজনৈতিক আন্দোলন, তাহার এমন স্পষ্ট ভাগাভাগি আদৌ সম্ভব কি না। বিশেষত লোকপাল বিল-এর মতো একটি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বিষয় লইয়া যে আন্দোলন সঞ্জাত ও প্রসারিত হইয়াছে, কেবল প্রাথমিক ভাবে সমাজ-পরিসর উৎসারিত হইয়াছে বলিয়াই কি তাহাকে অরাজনৈতিক হইতে হইবে? কোনও বিষয় লইয়া বিক্ষুব্ধ নেতা বা নেতৃবৃন্দ কত দূর অগ্রসর হইলে তাহা সামাজিক, এবং কত দূর অগ্রসর হইলে তাহা রাজনৈতিক বলিয়া গণ্য হইতে পারে? আসল কথা, ইহার কোনও ব্যাকরণগত বিধিনিষেধ নাই, গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনও বিষয়ই রাজনৈতিক পরিসরে আসিবার যোগ্য, যে কোনও ব্যক্তিই রাজনৈতিক পরিসরে সক্রিয় হইয়া উঠিবার অধিকারী। ইহার মধ্যে কোনও দ্বিচারিতা বা মিথ্যাভাষণ খুঁজিয়া কংগ্রেস নেতৃমহল অযথা শক্তিক্ষয় করিতেছেন। নাগরিক সমাজের উৎস সাধারণত রাজনৈতিক সমাজের বাহিরেই, কিন্তু যে কোনও বক্তব্য বা কার্যক্রম লইয়া যদি নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক সমাজে প্রবেশ করে বা রাজনৈতিক সমাজে পরিণত হয়, তাহা অনৈতিক তো নহেই, বরং তাহা গণতন্ত্রের সম্মান-বর্ধনকারী। ব্যক্তিগত আক্রমণের ঊর্ধ্বে উঠিয়া দিগ্বিজয় সিংহ প্রমুখ কংগ্রেস নেতাদের তাই একটি মৌলিক সত্য খেয়াল রাখা প্রয়োজন: লোকপাল আন্দোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা যেমনই হউক না কেন, ইহা আদতে একটি রাজনৈতিক বিষয়, সংসদীয় রাজনীতির অন্তর্গত বিষয়। কোনও আন্দোলনকারী নেতা যদি বিষয়টি লইয়া শেষ পর্যন্ত লড়িতে চান, তাহা হইলেও তাঁহাকে সংসদের শরণাপন্নই হইতে হইবে, এবং সে ক্ষেত্রে তাঁহারা নিজেরাও সেই সংসদীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় প্রবেশ করিতে চাহিলে আপত্তির স্থান নাই। সক্রিয়, সচেতন নাগরিক কোন দলের হইয়া বা কোন আদর্শের বৃত্তে দাঁড়াইয়া সেই প্রবেশপথ রচনা করিবেন, তাহা একান্ত ভাবে তাঁহারই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। রাজনীতির লড়াই রাজনীতির অঙ্গনেই হইবে। রাজনীতির ভাষাতেই হইবে। গণতন্ত্রে রাজনীতির বৃত্ত কোনও বদ্ধ বৃত্ত নহে, মুক্ত বৃত্ত। |