|
|
|
|
শুনলেন চা-বাগানের দুঃখও |
জমজমাট প্রথম দিনে গরহাজির গোর্খাল্যান্ড |
অনিন্দ্য জানা • দার্জিলিং |
ওয়েলকাম টু সুইৎজারল্যান্ড!
ছ’টা বেজে গিয়েছে। ঝুপ করে সন্ধে নেমে গিয়েছে পাহাড়ে। দার্জিলিং শহরে ঢুকছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়। দু’পাশে কাতার দিয়ে লোক। সেই ভিড় থেকেই আচম্বিতে উড়ে এল স্বাগত সম্ভাষণটা।
গাড়ির সামনের সিট থেকে মুখ ফেরালেন তৃপ্ত মমতা, “আমি ওদের বলেছিলাম, নো গোর্খাল্যান্ড! ওনলি সুইৎজারল্যান্ড। এরা দেখছি সেটা মনে রেখেছে!”
‘ওরা’ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (জিজেএম) নেতৃত্ব। ‘এরা’ পাহাড়ের আমজনতা।
মমতার ওই তিনটে বাক্যের মধ্যে একটা তৃপ্তি মিশে ছিল। সম্ভবত তার সঙ্গে মিশে ছিল এক অনুচ্চ গরিমাও গোর্খাল্যান্ডটা ভুলিয়ে দিতে পেরেছি! |
|
মিরিকে পানিঘাটা চা বাগানে শ্রমিকদের সঙ্গেই চা পাতা তুলছেন
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চার মাসের মধ্যে পাহাড়ে এ নিয়ে তৃতীয় বার এলেন মমতা। প্রথম বার পাহাড়-চুক্তি সই অনুষ্ঠানে। তাকে অবশ্য সে অর্থে পাহাড়ে-আসা বলে না। সুকনা তো সমতলেই। দ্বিতীয় বার ভূমিকম্পের অব্যবহিত পরে। যখন পাহাড়ের মানুষ ধ্বংসের রাতের পর ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলেন, দুয়ারে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী! কিন্তু সেটাও ‘দার্জিলিং-সফর’ ছিল না।
সে দিক দিয়ে এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতার মোর্চা নেতা বিমল গুরুঙ্গের গর্ভগৃহে পদার্পণ!
যাঁর সঙ্গে দার্জিলিঙে পৌঁছনোর আধ ঘণ্টার মধ্যে বৈঠকে বসেও পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী। বিমলের সঙ্গী রোশন গিরি, হরকা বাহাদুর ছেত্রী, জিটিএ-র সংবিধান বিশেষজ্ঞ এল বি পারিয়ার। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব, পর্যটন সচিব রাঘবেন্দ্র সিংহ, পার্বত্য বিষয়ক দফতরের সচিব অনিল বর্মা। |
|
মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা মোর্চা প্রধানের। ছবি: অশোক মজুমদার। |
সপার্ষদ বিমলের পর মমতার বৈঠক হল বিমলের স্ত্রী আশা গুরুঙ্গের নেতৃত্বাধীন ‘নারী মোর্চা’র সঙ্গেও।
এখানে আসার আগেই মমতা জানতেন, ভূমিকম্পের ক্ষতি সামলাতে তাঁর কাছে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার দাবি জানাবেন মোর্চা নেতারা। এবং আসার আগেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক মহলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইতিমধ্যেই তিনি প্রায় ৫০০ কোটি টাকা সাহায্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা মন্ত্রক থেকে যাতে দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষকে সেই সাহায্য করা হয়, তা তিনি দেখবেন।
আর বৈঠকে মোর্চা নেতাদের তিনি যা জানিয়েছেন, তার মোদ্দা কথা দীর্ঘ ৩৫ বছর দার্জিলিঙে কোনও কাজ হয়নি। পাহাড়ের নেতারা কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই করে অর্থ জোগাড় করুন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা তাঁর ‘করণীয়’ করবেন (যেমন, সিকিমে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে আসা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলকে আজ, মঙ্গলবার শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙে টেনে-আনা। যাতে মমতা তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন)। আশ্চর্যের কী যে, বৈঠক-উত্তর বিমল-উদ্ধৃতি, “উনি (মমতা) বাংলার মা। আমরা ওঁর সন্তানের মতো। ওঁর কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা।” মনে রাখুন, কোথাও কোনও আলাদা রাজ্যের দাবি নেই। এমনকী, বিমল যে গাড়ি চেপে এলেন মমতার সঙ্গে বৈঠক করতে, তাতেও ‘জিএল’ নাম্বারপ্লেট লাগানো নেই। নম্বরটা সিকিমের।
বিমলরা কি রাজ্যের কাছে অর্থ দাবি করছেন? |
|
হাত বাড়ালেই...খুদে লামাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। অশোক মজুমদারের তোলা ছবি। |
জবাব, “নাহ্! রাজ্য কী করে দেবে? বামেরা তো রাজ্যকে দেউলিয়া করে দিয়ে গিয়েছে। ওই টাকাটা যাতে কেন্দ্র দেয়, সেটা নিয়ে উনি উদ্যোগী হবেন।”
তবে সে ভবিষ্যতের কথা। আপাতত বর্তমান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ‘আশ্বস্ত’। দার্জিলিঙে আসার সময় সোমবার তাঁকে ঘিরে যে উচ্ছ্বাস এবং উৎসাহ মমতা দেখলেন, তাতে তাঁর তৃপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ রয়েছে যা দেখলেন এবং শুনলেন, তাতেও। বাগডোগরায় নেমে দার্জিলিঙে আসার চিরাচরিত রাস্তা হিলকার্ট রোড বা পাঙ্খাবাড়ি রোড ধরে না-এসে মমতা এসেছেন অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, কিন্তু নয়নাভিরাম রাস্তা ধরে। ব্যাঙডুবি হয়ে একের পর এক চা-বাগানের পাশ দিয়ে, পানিঘাটা, মিরিক, সুকিয়াপোখরি হয়ে ঘুম। সেখান থেকে দার্জিলিঙের পথে।
বাগডোগরায় নামা ইস্তক তাঁকে ঘিরে উদ্দন্ড ভিড়। সেখান থেকে যে রাস্তায় মমতা দার্জিলিঙে পৌঁছলেন, তা অপেক্ষাকৃত জনবিরল (লম্বা-লম্বা প্রাচীন পাইন এবং ঝাউ গাছে ঘেরা রাস্তা দেখে মুগ্ধ মুখ্যমন্ত্রী। আই-প্যাড বার করে নিজে তো ছবি তুলতে শুরু করেছেনই, পরিকল্পনা করতে শুরু করেছেন, রাস্তার পাশে পাহাড়ের উপর ছোট ছোট কটেজ যদি বানিয়ে দেওয়া যায়। দার্জিলিং এখন জমজমাট। তাই নতুন জায়গা তৈরি করতে হবে পর্যটনের জন্য)। কিন্তু সেখানেও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থোকা থোকা লোক। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দার্জিলিং-প্রত্যাগত পর্যটকের দল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁরা ঝেঁটিয়ে এসেছেন বেড়াতে। ‘শান্তির পাহাড়ে’। ভূমিকম্পের পর সিকিমের একটা অংশ যদি তাঁদের কাছে দূরাতিগম্য হয়ে থাকে, তা হলে অন্য কারণ অবশ্যই দার্জিলিং পাহাড়ের অতীতে ফিরে-যাওয়া। এখনও পর্যন্ত। |
|
চা শ্রমিকদের সঙ্গে ঘুরে দেখলেন চা বাগানও। সোমবার দার্জিলিঙে অশোক মজুমদারের তোলা ছবি। |
মমতার গাড়িতে ‘খাদা’ (গোর্খাদের তরফে সম্মানজনক উত্তরীয়)-র পাহাড় জমল। জমল বনজ গাছের ডাল কেটে যত্ন এবং আন্তরিকতা দিয়ে বানানো ফুলের তোড়ার স্তূপ। চা-বাগানের আদিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে গেলেন তিনি। যেমনটা করে থাকেন। হুটহাট গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। কখনও হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন আদিবাসীদের মধ্যে। কখনও রাস্তার পাশে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ গুম্ফা দেখে নেমে দাঁড়ালেন পুঁচকে পুঁচকে মুণ্ডিতমস্তক লামাদের সামনে। সফরসঙ্গী মুকুলবাবুকে বললেন, গুম্ফার নামটা লিখে নিতে। সারিয়ে দিতে হবে। কখনও বাগানের মহিলা শ্রমিকদের কাছে শিখলেন, কী করে ‘দু’টি পাতা, একটি কুঁড়ি’র স্কিল ব্যবহার করে চা-পাতা তুলতে হয়। শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে বললেন, “অনেক দিনের শখ ছিল চা-বাগানে নেমে চা-পাতা তোলা। সেটা হয়ে গেল। এটা আমার পুজো বোনাস।” এক নিশ্বাসে শ্রমিকদের প্রশ্ন করলেন, তাঁদের বিপিএল কার্ড আছে কি না। রেশনে চাল পান কি না (খাদ্য দফতর থেকে স্বল্পমূল্যে চাল সরবরাহ করা হয় জেনে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে ফোন করে একচোট প্রশংসাও করলেন)। সপ্তাহে কত বেতন পান। হাতের কর গুনে হিসেব করলেন, তা হলে দিনপ্রতি মজুরি কত। তার পর স্বগতোক্তি করলেন, “এরা দেখছি, ন্যূনতম মজুরিও পায় না!”
মুখ্যমন্ত্রী এই পথে যাবেন শুনে আদিবাসী শ্রমিকরা তাঁদের ঐতিহ্যপূর্ণ পোশাক পরে দাঁড়িয়েই ছিলেন রাস্তার পাশে। সঙ্গে ধামসা-মাদল আর গান। গাড়ি থেকে নেমে এসে তাঁদের জড়িয়ে-ধরা মুখ্যমন্ত্রীকে সেই মহিলারা বললেন, তাঁদের ভারী দুঃখ। পাহাড়ের সমৃদ্ধির ছিটোফোঁটা আঁচও তাঁদের গায়ে লাগেনি। বললেন, “আমাদের কথা মনে রাখবেন। আমাদের আশীর্বাদ নেবেন।”
মমতা বললেন, “সেই জন্যই তো নামলাম!” এ তো গেল চা-বাগানের কথা। ব্যাঙডুবি থেকে মিরিক যাওয়ার রাস্তা ভাঙাচোরা দেখে প্রথমে পূর্ত দফতরের প্রিন্সিপাল সচিব অজিত বর্ধনকে ফোনে ধরে বললেন, “এই রাস্তাটা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সারাতে হবে।” কিছু পরে পূর্তমন্ত্রী সুব্রত বক্সীকে ফোন করেও একই নির্দেশ দিলেন। তার পর বললেন, “রাজ্য চালাতে গেলে মহাকরণে বসে অফিস করতে হয়। সেটা ঠিক। কিন্তু মাঝেমধ্যে এমন সরেজমিনে ঘুরে নিজের চোখে অবস্থা দেখতে হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। নইলে বাস্তবটা বোঝা যায় না।”
কিন্তু এ সবই হল, খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে ‘মুড-পিস’। অর্থাৎ, পরিপার্শ্বটা কেমন, তার একটা ছবি। সাধারণত কোনও ভিভিআইপি-র সফরের প্রথম দিনে যা হয়ে থাকে। এ দিন তো আরওই হবে। কারণ ভিভিআইপি স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এবং তাঁর গন্তব্যস্থল হাজার হোক, দার্জিলিং। কিন্তু মুড-টুড ছাপিয়ে যা এই মমতা-সফরের প্রথম দিনে বেশি ‘তাৎপর্যের’। |
|
বাগডোগরা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন
পাহাড়ের লেপচা সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের একাংশ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
কী? না, পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রাপথে মুখ্যমন্ত্রীর কানে একবারও ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটা আসেনি! জিজেএম-এর সাদা-সবুজ-হলুদ তেরঙা পতাকা চোখে পড়েছে বটে। তেরঙা তোরণও আছে। কিন্তু তার ওপরে আগের মতো ‘গোর্খাল্যান্ড’ শব্দটা কোথাও লেখা নেই (শহরের কিছু কিছু এলাকায় এখনও ‘ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড’ লেখা বটে। কিন্তু সে সবই, মনে হচ্ছে, অতীত)! ‘জিন্দাবাদ-টিন্দাবাদ’ তো আছেই। মমতার কানে এসেছে এমনকী, ‘ভারতমাতা’ বা ‘দুর্গামাতা’ সম্বোধনও! আজ, মঙ্গলবার দার্জিলিঙের ম্যালে এক মাস ব্যাপী পর্যটন উৎসবের উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর যাবেন ডুয়ার্স। সেই নিরিখে ‘প্রশাসক’ হিসেবে তিনি যে শান্তি এবং উন্নয়নের’ বার্তা নিয়ে উত্তরবঙ্গে এসেছেন, তার ‘মুখবন্ধ’ এ দিন থেকেই শুরু হল।
যে ‘মুখবন্ধ’ বলছে, আলাদা ‘গোর্খাল্যান্ড’ রাজ্যের দাবি উচ্চারিতই হল না রাজ্যভাগের তীব্র বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর সামনে।
ওই যে বললাম, ‘গোর্খাল্যান্ড’ নয়। ‘সুইৎজারল্যান্ড’। |
|
|
|
|
|