আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। তবু ধনদেবীর আড়ি বা প্রতিমা বসবে না ওঁদের গ্রামে। অন্যত্র আলোকমালায় ভাসলেও ওঁরা অন্ধকারেই থেকে গিয়েছেন। শারদ উৎসবে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ কপালে জোটেনি ওঁদের। পুজোর চারদিন সর্বত্র ঢাক- ঢোল-কাঁসির আওয়াজে মুখরিত হলেও পুজোর আনন্দ অধরাই থেকে গিয়েছে ওঁদের কাছে। সাদা খোলের লালপাড়ের শাড়ি পরে মাকে বরণ করতে পারেননি এখানকার বধূরা। গোটা গ্রাম জুড়ে শুধু ছেয়ে রয়েছে বিষণ্ণতা। চোখের জলেই যষ্ঠী থেকে দশমী কেটেছে ওঁদের। গত তিন মাস ধরে জলমগ্ন উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার স্বরূপনগর ব্লকের ২৮টি গ্রামের বাসিন্দারা তাই মনমরা।
মা দুর্গার পায়ে পায়েই এসে পৌঁছন লক্ষ্মীদেবী। কিন্তু জলমগ্ন স্বরূপনগরের এই সব এলাকায় তাঁর আসন আর পাতার মতো অবস্থায় নেই মানুষগুলি। আজও বহু ঘরবাড়ি ডুবে আছে জলে। মেলেনি প্রয়োজনীয় ত্রাণ। যাঁদের ঘর ধসে গিয়েছিল, পলিথিনের মোটা চাদরই এখন তাঁদের মাথার উপর ছাদ। |
গত অগস্ট মাসে অতিবৃষ্টি এবং ইছামতী, পদ্মা ও যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে নোনাজলে প্লাবিত হয়েছিল স্বরূপনগরের বহু এলাকা। কাঁটাবাগান, ঘোলা, ঢিপি, মোল্লাডাঙা, বারঘরিয়া, নলাবড়া, খদ্দরসিং, শ্রীরামপুর, নিশ্চিন্দিপুর, পোলতা, ভূমিতলা, গোপালপুর, দর্গাপুর-সহ প্লাবিত হয় বহু গ্রাম। বৃষ্টি একটু থামলে জল সরে যাওয়ার আশায় যখন দিন গুনছিলেন, তখনই ফের দুর্গাপুজোর আগে মহালয়ার দিন বাঁধ ছাপিয়ে জল ঢোকে ওই সব এলাকায়। ভেসে যায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি। আজও পলিথিনের শিটই বহু গৃহস্থের মাথার ছাউনি। নোনাজল ঢুকে মরে গিয়েছে জমির ফসল। চাষবাস বন্ধ। ভেসে গিয়েছে পুকুর। জমির ফসল, পুকুরের মাছ নষ্ট হয়ে ক্ষতির পরিমাণ কম নয়। এই ক্ষতির ধাক্কা সামলে আর পুজোর আনন্দে সামিল হতে পারেননি এখানকার মানুষ। লক্ষ্মীপুজোতেও যে দেবীকে বরণ করতে পারবেন না তা ভেবে স্বাভাবিক ভাবেই চোখের জল ফেলছেন গৃহলক্ষ্মীরা।
সোমবার শগুনা পঞ্চায়েতের ঘোলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, উঁচু রাস্তার উপরে সার দিয়ে থাকা পলিথিনের নীচে বাস করছেন বহু পরিবার। পাশেই গরু, ছাগল রাখার ব্যবস্থা। লোকজন দেখে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধা কমলা বাছাড়। জলমগ্ন বাড়িঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “আগেই মাটি হয়েছিল দুগা৪পুজোর আনন্দ। দেবীর কপালে সিঁদুর পর্যন্ত ছোঁয়াতে পারিনি। প্রতিবছর লক্ষ্মীপুজো করি। এ বারঘরদোর জলে ডুবেছে। লক্ষ্মীর আসন পাতব কোথায়? মাকে এ বার ঘরে আনতে পারলাম না। একই অবস্থা অঞ্জনা বৈদ্য, অনিমা বৈদ্য, অপর্ণা মণ্ডল, বীণা মণ্ডলের। তাঁদের কথায়, “অগস্ট মাস থেকে রাস্তাতেই বাস করছি। অথচ সরকারের থেকে কেউ একটি বারের জন্যও খোঁজ নিতে এলেন না। ধান, পাট, সব্জি সব জলে ধুয়ে গিয়েছে। বাড়িঘর পড়ে গিয়েছে। পলিথিনের নীচে বাস করে মা লক্ষ্মীর পুজো করা যায়। স্বামী ও এক মেয়েকে নিয়ে লক্ষ্মী মণ্ডলও পড়ে আছেন রাস্তায়। পলিথিনের নীচে সংসার গোছাতে গোছাতে জানালেন, “স্বামীর কাজ নেই, দেড় মাস হল প্রশাসনের কাছ থেকে কোনওরকম ত্রাণ পাইনি। বেঁচে আছি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দয়ায়।” চন্দনা মণ্ডলের কথায়, “দুর্গাপুজোয় বাচ্চাদের জামাকাপড় কিনে দিতে পারিনি। সংসারের যে হাল তাতে আবাহনের আগেই আমাদের লক্ষ্মী বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। জলবন্দি মানুষের দুঃখের কথা শোনার সময় নেই কারও। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার লোকেরা পাশে না দাঁড়ালে এতদিনে হয়তো মরেই যেতাম।” গোটা জলবন্দি এলাকাতেই একই সুর।
দুর্গতদের ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে শগুনা পঞ্চায়েতের প্রধান কনক চন্দ্র মণ্ডল বলেন, “ত্রাণ এসেছে। কিন্তু প্রশাসনিক কিছু অসুবিধার কারণে তা বল বণ্টন করতে দেরি হচ্ছে। তবে চেষ্টা হচ্ছে দ্রুত দুর্গতদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার।” পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নারায়ণ গোস্বামী বলেন, “পুজোর ছুটির আগে ৭০ কুইন্টাল চাল শগুনা পঞ্চায়েতের প্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন জলবন্দি দুর্গতেরা ত্রাণ পাচ্ছেন না তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জলবন্দিদের মধ্যে ত্রাণ বিলি নিয়ে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে সুনীল মণ্ডল জানান, আমাদের এটি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তার বাৎসরিক উৎসবের বাজেট থেকে ছেঁটে সেই টাকায় যতটা সম্ভব দুর্গতদের ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সরকারি ত্রাণের অব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরূপনগরের জলবন্দি মানুষের কাছে এখন লক্ষ্মী এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য। |