|
|
|
|
অধরা লক্ষ্মী ২ |
|
ধুঁকছে কৃষি-খামার, বীজের
জন্যও চাষির ভরসা ব্যবসায়ী সুমন ঘোষ ও অভিজিৎ চক্রবর্তী • মেদিনীপুর |
|
কৃষি এখনও প্রধান জীবিকা। জনসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কৃষি-উৎপাদন কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে
না। কৃষি-নির্ভর পরিবারগুলিতে সেই অভাবের বারোমাস্যা। ‘পিছিয়ে পড়া’ জেলার তকমা আর ঘুচছে
না পশ্চিম মেদিনীপুরের। কৃষিতে সমৃদ্ধি অর্জনের উপায়-সম্ভাবনাগুলি রয়ে যাচ্ছে অধরাই।
কোজাগরী-র আরাধনাপর্বে আনন্দবাজার-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদন। |
কৃষি-নির্ভর জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর। উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে জেলাতেই তৈরি করা হয়েছিল একাধিক কৃষি-খামার। একরের পর একর জমির উপর এখনও খামারগুলি রয়েছে। কিন্তু বীজের জন্য জেলার কৃষিজীবীদের নির্ভর করতে হয় সেই ভিন্রাজ্য বা বেসরকারি সংস্থার উপরেই। কারণ, রোগ বাসা বেঁধেছে কৃষি-খামারগুলিতেই। বীজ উৎপাদন হবে কোত্থেকে! না কৃষি দফতর, না রাজ্য সরকার কোনও পক্ষেরই রুগ্ণ কৃষি-খামারের স্বাস্থ্যোন্নতি নিয়ে তেমন ভাবনাচিন্তার লক্ষণ নেই। ফলে যা হওয়ার তাই। লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্র রয়েছে, একরের পর একর জমি রয়েছে, কর্মীও রয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বেশি দামের হলেও ভিন্রাজ্য বা বেসরকারি সংস্থার বীজের উপরেই ভরসা করতে হচ্ছে জেলার চাষিকে।
মেদিনীপুরের আবাসে কৃষি-খামারের জমির পরিমাণ ৩৩ একর। চাষযোগ্য জমিই রয়েছে ১৮ একর। এত বড় এলাকা নিয়ে যে খামার, সেখানে গত বছর মাত্র ৭০ কুইন্টাল ধানবীজ, ১০ কুইন্টাল সরষে-বীজ, ১ কুইন্টাল মুগ, ৩ কুইন্টাল তিল ও মোটে ২৫ কুইন্টাল আলুবীজ তৈরি হয়েছিল! ইতিমধ্যে আলুবীজ আর তৈরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জেলা কৃষি দফতর। কারণ, আলু হিমঘরে রাখা ও তা পরে বিক্রি করা নিয়ে ফি-বছর সমস্যা হচ্ছে। অন্য ফলনের দিকে চাষিদের উৎসাহিত করার প্রকল্প নিয়েছে কৃষি দফতর। তা না-হয় হল, অন্য বীজের উৎপাদনই বা এত কম কেন? খামারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর রাজেশ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “প্রথমত পাথুরে মাটি। কর্মী সমস্যাও রয়েছে।” ফলে খামারে চাষের এলাকা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেটুকু চাষযোগ্য জমি রয়েছে, তারও ব্যবহার হচ্ছে না। |
|
উন্নত মানের বীজ তৈরির জন্য এক সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয়েছিল
কৃষি খামার। রক্ষণাবোক্ষণের অভাবে সেগুলি আজ পরিত্যক্ত। এমনই একটি জীর্ণ
কৃষি খামার ক্ষীরপাইয়ে। ছবি: কিংশুক আইচ। |
অথচ খামারে উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের সব ব্যবস্থাই ছিল এক সময়ে। এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, দু’ জন কেপিএস (কৃষি-প্রযুক্তি সহায়ক), এক জন করণিক, এক জন পিওন এবং ৪২ জন কৃষিশ্রমিকের পদ ছিল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, কেপিএসদের খামারে থাকার জন্য আবাসনও ছিল। বর্তমানে সেই আবাসন ভেঙেচুরে শেষ। ৪২ জন কৃষিশ্রমিকের মধ্যে রয়েছেন ২৫ জন। এগুলি যদি খামতির দিক হয়, তা হলে সদর্থক দিকও রয়েছে। খামারে ধান রোপণ, কাটা, ঝাড়ার যন্ত্র রয়েছে। ফসল তুলে রাখার শেড রয়েছে। কিন্তু বীজ উৎপাদনের কাজ আর তেমন হচ্ছে কই?
ক্ষীরপাই কৃষি খামারেও সাড়ে ১৮ একর জমিতে ধান, তিল, আলু, গম, সরষে-বীজ উৎপাদনের কথা। তার জন্য পাওয়ার টিলার, সেচের ব্যবস্থা, বীজ রোপণ-সহ নানা কাজের আধুনিক যন্ত্রপাতিও রয়েছে। কিন্তু ৪০টি কৃষিশ্রমিক পদের ৩৪টিই এখন শূন্য। কয়েক জন অস্থায়ী শ্রমিক নিয়ে নমো নমো করে চলছে সামান্য বীজ উৎপাদনের কাজ। যা চাষিদের বিশেষ কোনও উপকারেই লাগছে না। ফার্ম-ইনচার্জ বসন্ত হেমব্রমের পাল্টা প্রশ্ন, “কর্মী না থাকলে কী ভাবে বেশি বীজ উৎপাদন করা যাবে! নতুন কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না।”
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিভিন্ন সময়ে মোট ১২টি কৃষি-খামার তৈরি হয়েছিল। চাষিদের চাহিদা মতো বীজ উৎপাদন করাই ছিল খামারগুলির লক্ষ্য। ১২টি খামারে ১৬২০ জন কৃষিশ্রমিক থাকার কথা। তার মধ্যে ১০২৩টি পদই এখন শূন্য। অর্থাৎ রয়েছেন মাত্রই ৫৯৭ জন! ফলে যন্ত্র থেকেও কাজে লাগছে না। সব কৃষি-খামারেই ধইঞ্চার চাষ হচ্ছে বেশি। যা আসলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ানোর বাইরে তেমন আর কাজে লাগে না। খামারের কোনও সুফলই পাচ্ছেন না চাষি। অভিযোগ, সরকারি উদাসীনতার জেরেই আজকের এই রুগ্ণতা।
তাই বাধ্য হয়েই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার বীজই কিনছেন চাষিরা। তাতে ফলন কম হলে বা রোপণের পরে নষ্ট হয়ে গেলেও কেউ দায় নেওয়ার নেই। শালবনির চাষি রণজিৎ কারক বলেন, “সরকারি খামার থেকে বীজ পেলে দাম লাগত কম। এখন আলু চাষ করতেও আমাদের পঞ্জাবের বীজের জন্য বসে থাকতে হয়।” চন্দ্রকোনার চাষি চঞ্চল রায়ও বলেন, “আমাদের জেলায় কত আলু চাষ হয় ভাবুন। বিদেশে রফতানিও করা যেতে পারে। অথচ পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য আলুবীজ তৈরির ব্যবস্থাটুকুও নেই।” একই হাল ধান, আলু, তিল, সরষের ক্ষেত্রেও।
খামার আছে নামেই। কাজে নেই।
|
(চলবে) |
|
|
|
|
|